সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

১৩ দিনেও মেলেনি আনারের মরদেহ, নানা প্রশ্ন

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২৪, ০৮:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

এমপি আনারের মরদেহ না পাওয়া গেলে কী হবে?

ভারতের কলকাতায় খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহের সন্ধান মেলেনি ১৩ দিনেও। মরদেহের সন্ধানে শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা খালে তল্লাশি চালায় ভারতীয় সিআইডি ও পোলেরহাট থানা পুলিশ। খালে জাল ফেলা হয়, নামানো হয় নৌকাও। ব্যবহার করা হয় ড্রোনও। ব্যাপক তল্লাশির পরও মরদেহের কোনো অংশ খুঁজে না পাওয়ায় দুপুর ২টার দিকে অভিযান বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা।

চিকিৎসা করাতে ভারতে গিয়ে একজন সংসদ সদস্যের এমন হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে৷ হত্যাকাণ্ডের ১৩ পরও মরদেহ না পাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার মূলহোতা তারই বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আখতারুজ্জামান শাহিন। সংস্থাটি জানায়, শাহিনই পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে হত্যাকারীদের দিয়ে এমপি আনারকে হত্যা করান।


বিজ্ঞাপন


তবে বিষয়টি অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন অভিযুক্ত শাহিন। এ হত্যাকাণ্ডে তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে মোবাইল ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহিন।

কেউ বলছেন, বাল্যবন্ধু নয়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরেই এমপি আনারকে সোনা কারবারিরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ব্যবসায়িক ২০০ কোটি টাকা দ্বন্দ্ব। এই ঘটনায় জড়িতদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ হয়।

এমপি আনার নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবার স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি না করে সরাসরি ডিবি পুলিশের দারস্থ হওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

এই খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনজন ও ভারতে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশে গ্রেফতার তিনজন হলেন— আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, সেলেস্তি রহমান (সিনথিয়া রহমান) ও তানভীর ভূঁইয়া।


বিজ্ঞাপন


MP_Anar--3_Arrest

আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া আদালতে জানিয়েছেন, আখতারুজ্জামান শাহীনের সাথে ব্যবসা ছাড়াও কিছু বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। যার কারণে তিনি এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই বিষয়টি শিমুলকে জানালে তিনি তাকে সহায়তার জন্য ভারত যান। মূলত তাদের পরিকল্পনাতেই আনারকে হত্যা করা হয়। এছাড়া শিমুলের সাথে এমপি আনারের রাজনৈতিক পার্থক্য ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে।

এদিকে এমপি আনার হত্যার ঘটনা তদন্তে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল রোববার (২৬ মে) কলকাতায় গেছেন। টিমের অপর দুজন হলেন— ওয়ারী বিভাগের ডিসি আব্দুল আহাদ ও এডিসি শাহীদুর রহমান।

অন্যদিকে এ খুনের ঘটনায় দুই বাংলাদেশিসহ ভারতে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের নিয়ে কয়েকদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন দেশটির সিআইডির সদস্যরা। কিন্তু এমপি আনারের মরদেহের সন্ধান এখনও মেলেনি। যদিও ভারতে গ্রেফতার হওয়া কসাই জিহাদ ওরফে জাবেরের বরাত দিয়ে দেশটির সিআইডি দাবি করেছে, আনারের লাশ কাটার জন্যই তাকে ডাকা হয়েছিল। তিনি মূলত একজন কসাই। সেই সূত্রে তাকে ভাড়া করা হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশে থাকা জিহাদের পরিবার ও স্ত্রী গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, জিহাদ কখনো কসাই ছিলেন না। তিনি কখনো কসাইয়ের কাজও করেননি।

জিহাদ কলকাতার পুলিশকে জানিয়েছেন, লাশটি কাটার পর তিনি টুকরো টুকরো করেন। পরে সেগুলো লাগেজে ভরা হয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে ফেলে দেওয়া হয়। তবে কোন কোন এলাকায় লাশের টুকরো ফেলা হয়েছে তা জানাতে পারেনি ভারতীয় পুলিশ। এদিকে এই ঘটনায় গ্রেফতার চালকও ভারতীয় পুলিশকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে ডিবির দাবি, গ্রেফতার শিমুল লাশের টুকরোর ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে। সে নিজেই প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা টুকরোগুলো ফেলে দিয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ বলেন, তিনি (এমপি আনার) যে হত্যার শিকার হয়েছে সেই প্রমাণ তো আমরা আপনাদেরকে দেব না। সেটা পরে আপনাদের আমরা জানাবো। তদন্তে স্বার্থে বলা যাচ্ছে না। প্রমাণ পেয়েছি বলেই তার নামে মার্ডার মামলা হয়েছে।

অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছে না

যাকে এমপি আনারের বান্ধবী বলা হচ্ছে সেই সেলেস্তি রহমানের নাম নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। শুরু থেকে তার নাম সেলেস্তি বলা হলেও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বলছে, ওই ফ্লাটে সিনথিয়া নামে এক নারীকে নিয়ে এমপি সেদিন প্রবেশ করেছিলেন। পরে দুজন যুবক লাগেজ নিয়ে ও সেই নারী তাদের সাথে বের হলেও এমপি বের হননি। বলা হচ্ছে, সেই নারীকে দিয়েই এমপিকে হানি ট্রাপে ফেলা হয়েছিল।

কিন্তু সেলেস্তি রহমান ডিবির কাছে দাবি করেছেন, তিনি এই হত্যার সময় ছিলেন না। তবে ভারতীয় সিআইডি মনে করছে, সেলেস্তি বা সিনথিয়াকে হত্যাকারীদের কেউ ভাড়া করেছে বা তাদের সাথে তার যোগসাজস রয়েছে। কারণ এমপি আনার কলকাতায় ব্যবসায়িক কাজে গিয়েছিলেন। গিয়েই তার বন্ধু গোপালের বাসায় ওঠেন। গোপালের বাসা কলকাতা থেকে প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে কে তাকে ফোন করে ডেকে আনলো আর লাল প্রাইভেট কারটিতে করে কারা তাকে সেই ফ্লাটে নিলো।

MP_Anar---Aktaruzzaman_Shahin

এছাড়া সেই ফ্লাটের দারোয়ানদের গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়নি ভারতীয় সিআইডি। এমপি আনারের বন্ধু গোপালকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। ফ্ল্যাটে যে রক্ত পাওয়া গেছে তা এমপির রক্তের সাথে ম্যাচ করা হয়েছে কিনা, তাও জানা যায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে একবার বলা হলো খন্ডিত লাশ পাওয়া গেছে, আবার বলা হচ্ছে লাশ পাওয়া যায়নি— কোনটি সত্যি?

একবার বলা হলো স্বর্ণ চোরাচালান দ্বন্দ্ব নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আবার শনিবার ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ জানান, তারা মনে করছেন হত্যাকাণ্ডের আসল কারণ এখনো তারা জানতে পারেননি। তবে ব্যবসায়িক ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে তাদের ধারণা।

বাংলাদেশে আসা ভারতীয় সিআইডির টিমের সদস্যরাও বাংলাদেশি কোনো গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি।

এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাংলাদেশের কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নাম শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডিবির প্রধানকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা কোনো জবাব দেননি।

তবে হত্যাকাণ্ডে কোনো ভারতীয় জড়িত কিনা, এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারতীয় জড়িত আছে কিনা আমরা এমন বিষয় উড়িয়ে দিইনি। আমরা বলেছি তদন্ত চলছে। আমরা কিন্তু এখনো বলি নাই কারা কারা জড়িত। আমরা বলেছি একটা সম্যক ধারণা পেয়েছি। আমরা সেই ধারণা নিয়ে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যেসব তথ্য এসেছে আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। মন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের এখানকার মানুষও জড়িত আছে, ভারতের কেউ জড়িত থাকলে তাদের গোয়েন্দারা আমাদের জানাবে। তারাও বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করছে।

রহস্য উদ্ঘাটনে কতদিন লাগবে?

ভারতীয় সিআইডি ও পুলিশের তথ্য মতে, গত ১৩ মে হত্যা করা হয় এমপি আনারকে। পরে তার লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে টুকরো টুকরো করা হয়। ঘটনার ১৩ দিন পার হলেও লাশের সন্ধান এখন মিলেনি। আদৌ কি সেই লাশের টুকরোগুলো মিলবে?

১৫ বছর আগে ভারতে ঘাঁটি গেড়েছিলেন এমপি আনার

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমপি আনার বিএনপি সরকারের আমলে ইন্টারপোলের একজন তালিকাভুক্ত আসামি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সেই সময়েই স্বর্ণ চোরাচালান, নারী পাচার ও মাদক ব্যবসার অভিযোগে মামলা হয়। সেই সময় তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি ভারতের কলকাতায় পালিয়ে যান। সেখানে স্বর্ণ ব্যবসায়ী এক বন্ধুর মাধ্যমে থেকে যান। পরে বাংলাদেশে নতুন মহাজোট সরকার আসলে তিনি ফিরে আসেন।

এমআইকে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর