বছর পাঁচেক আগেও নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আলতাদিঘীর টলমল পানিতে ফুটত গোলাপি পদ্মফুল।
বিশাল দিঘির চারপাশে ছিল হাজারো গাছপালা। গাছের ছায়ায় ঢেকে থাকা দিঘিটির শান্ত পানির দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়েছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। কিন্তু কয়েক বছরেই বদলে গেছে আলতাদিঘীর রূপ। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এখন খাঁ খাঁ করছে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান।
বিজ্ঞাপন
উদ্যানের দীঘি খনন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ ও গাছ রোপনসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাটা পড়ে নানা প্রজাতির হাজারো গাছ। এখন যেন ছোট্ট মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে আলতাদিঘী পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদীঘী জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ প্রকল্পের জন্য দিঘীটির চতুর্দিকের কয়েক হাজার গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলার ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, নাম জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প। কিন্তু চারপাশ ফাঁকা করে দিয়ে, দিঘি ও বনের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে এ কেমন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ!
২০১১ সালে ৪৩ একর আয়তনের আলতাদিঘীকে ‘আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালে জাতীয় উদ্যানের পাশের ১৭ দশমিক ৩৪ হেক্টর বনভূমিকে ‘বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ’ এলাকা ঘোষণা করে বন অধিদফতর। এখন জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বন অধিদফতর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের ১৭ জুন আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানের দিঘি পুনঃখননের কাজের উদ্বোধন করা হয়। এই উন্নয়নকাজের জন্য দিঘির চারপাশের কয়েক হাজার গাছ কাটার অভিযোগ করেছেন পরিবেশকর্মীরা।
বিজ্ঞাপন
বন বিভাগ বলেছে, সামাজিক বনায়নের আওতায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়নকৃত গাছগুলি অপসারণ করে স্থানটি দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আলতাদিঘীর খননকৃত মাটি দিয়ে নীচু স্থান ও পাড় সংস্কার করার জন্য দীঘির চারপার্শ্বে বিদ্যমান ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিগাছ যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ১৫টি লটে ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকায় টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়েছে।
জয়পুরহাট সরকারি কলেজের ভূগোল বিষয়ে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র সাদমান সাকিব বন্ধুকে সাথে নিয়ে এসছেন আলতাদিঘী দেখতে। গত রোববার বিকেলে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে। তারা ক্ষোভের সাথে বলেন, দিঘীটি অবশ্যই সংস্কার জরুরী কিন্তু তাই বলে এভাবে নির্বিচারে চর্তুদিকের সারিবদ্ধ সব গাছগুলো কাটতে হবে? গাছগুলো রেখে কি সংস্কার করা যেতো না? দিঘীর চতুর্দিক দেখে এটাকে আর দিঘী বলা যায় না । এ যেনো এক মরুভূমি।
এখানে ঘুরতে আসা নওগাঁ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘গাছ কাটার আগে এসব জায়গাতে বেশ কিছু পাখির বাসা দেখেছি। এখন সেখানে বালুর স্তুপ। এগুলো মেনে নেয়া যায়?
উদ্যানের উন্নয়ন কাজে গঠিত কমিটির সদস্য কায়েস উদ্দিনের দাবি, আলোচনা সভায় গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, হঠাৎ করে আলতাদিঘীতে এসে দেখি গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।
ধামইরহাটের বন বিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, সামাজিক বনায়নের আওতায় স্বল্পমেয়াদি সৃজিত মেয়াদোত্তীর্ণ বাগান করতে গাছগুলো রোপণ করা হয়েছিল। এসব গাছ ১০ থেকে ১২ বছর পর কাটা যায়। সেখানে এখন নতুন বনায়ন হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নওগাঁ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাফকুল ইসলাম বলেন, সৌন্দর্যবর্ধন বৃক্ষরোপনের মধ্যে নিহিত, নিধনে নয়। আজকের কর্তনকৃত গাছগুলো হতে সময় লেগেছে ১৫ থেকে ২০ বছর। অথচ নিমিষের মধ্যে তা ধংস করা হচ্ছে। আধুনিক নকশায় গাছ রেখেই সুন্দর পরিকল্পনা করা সম্ভব।
তিনি বলেন, আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান এ অঞ্চলে ফুসফুসের মতো কাজ করে। আমরা এবিষয়ে অনেক মিটিং মিছিল মানববন্ধন করেছি কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। পুরানো হাজার হাজার গাছগুলো যারা নির্বিচারে কাটছেন তারা অবশ্যই অপরাধ করছেন। এসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান শাহ জানান, খনন করা মাটি দিয়ে নিচু স্থান ও পাড় সংস্কারের জন্য দিঘির চারপাশের ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমণি গাছ কাটা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হলে পুরো আলতাদিঘি এলাকা আবারও সবুজে পরিণত হতে শুরু করবে। পাশাপাশি পরিবেশের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন এবং ইকো ট্যুরিজমের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আলতাদিঘীর ইতিহাস
অনেক আগে এ এলাকা ছিল বটু রাজার। জগদ্দলে ছিল সেই রাজার বাড়ি। তাঁর ছিল এক দয়াবতী রানি। রানী একদিন আবদার করলেন, তাকে বড় এক দীঘি খুঁড়ে দিতে হবে। রাজা বললেন, ঠিক আছে। তুমি হাঁটতে শুরু কর। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার পা ফেটে রক্ত বের না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত হাঁটতে হবে। এখান থেকে হাঁটা শুরু করে যেখানে গিয়ে পা থেকে রক্ত বের হবে সেই পর্যন্ত দীঘি কাটা হবে। রানী হাঁটতে থাকলেন। হাঁটা আর শেষ হয় না। রাজা পড়ে গেলেন চিন্তায়। শেষ পর্যন্ত পাশের দেশে গিয়ে দিঘী কাটতে না হয়। তাই কৌশলে তার সৈন্য দিয়ে রানীর পায়ে আলতা লাগিয়ে বললেন, রানীর পা ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। দীঘি সে পর্যন্তই খোঁড়া হল। ধীরে ধীরে সে দিঘি ভরে গেল টলটলে কাকচক্ষু জলে। তাতে পদ্ম ফুটল। প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট শেষ হলো। আর সে থেকেই এর নাম হয়েছে আলতাদিঘী। প্রায় হাজার বছরের স্মৃতি নিয়ে আজও সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী আলতাদিঘী।
এত প্রাচীন আর এমন বিশাল দিঘী বাংলাদেশে আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ দীঘির দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার, চওড়া প্রায় ৪০০ মিটারের মতো। গ্রামের লোকমুখে প্রচলিত আছে বৌদ্ধ যুগের কীর্তি এটি। দীঘির পাড় ঘেঁষে ভারত সীমান্ত। উত্তর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া, বিএসএফের সীমান্ত টইল, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতকে দেখা খুবই সহজ। আলতাদিঘীর পাড়ে দাঁড়ালে মনে হবে অনেকটাই সুন্দরবনের মতো, শীতের সময় অতিথি পাখির আগমন ঘটে।
প্রতিনিধি/একেবি

