শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের পেছনে থাকা পরিত্যক্ত একটি অ্যাম্বুলেন্সে ঠাঁই নিয়েছেন বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এক নারী। মানসিক ভারসাম্যহীন এই নারী কেবল নিজের নাম ‘রুমা’ আর বাড়ি আদালতে; এতটুকুই বলতে পারে। গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে থাকা এই নারী নিজের পরিচয় বা আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। হাসপাতাল কতৃপক্ষ, থানা পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ হতে খোঁজ করা হচ্ছে রুমার স্বজনদের।
হাসপাতাল এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানায়, গেল বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে হাসপাতাল চত্বরে দেখা মেলে রুমার। সে সময় কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন না তিনি। কিন্তু এখন মাঝে মধ্যে নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন ‘রুমা’। বাড়ি কোথায়, জানতে চাইলে তেমন কোনো ধারণা না দিতে পারলেও কোনো আদালত এলাকার ইঙ্গিত করেন তিনি। তিনি সারাদিন বাইরে ঘোরাঘুরি করেন। খুব দ্রুত হাঁটাচলা করেন। তার সঙ্গে বেশি কথা বলার চেষ্টা করলে রাগ করে অন্যত্র চলে যান। আর সবসময় বিড়বিড় করে কি জানি বলার চেষ্টা করেন। এই তীব্র শীতেও তিনি মোটা কাপড় চোপড় ছাড়াই চলাফেরা করেন। স্থানীয় দোকানিরা মাঝেমধ্যে চা-বিস্কিট খেতে দেন রুমাকে। আর প্রতিদিন দু’বেলা ভাত খাওয়ান হাসপাতালের সামনের চা দোকানি হেদায়েত মিয়া।
বিজ্ঞাপন
তীব্র শীতে তার পরিচয় চেয়ে একটি পোস্ট ছড়িয়ে যায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরপরই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভয়েস অব ঝিনাইগাতী এবং শেরপুর ৭১ এর সদস্যরা খাবার, শীতবস্ত্র ও কম্বল নিয়ে রুমার খোঁজ করেন। তাকে পাওয়া যায় ঝিনাইগাতী বাজারে। আর সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আসে পরিত্যক্ত সেই অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর।
ঝিনাইগাতী সদরের ইউপি সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ভয়েস অব ঝিনাইগাতী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাহিদুল হক মনির বলেন, প্রথম দিকে তাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোক ভেবে অনেকেই কানাঘুঁষা করে। পরে আমাদের জানায় ব্যপারটি। আমরা প্রথমে এসে দেখি অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। পরবর্তীতে আমরা নিয়মিত ওই নারীর বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছি, ইতোমধ্যে তাকে শুকনো খাবার ও শীতবস্ত্র দিয়েছি। তার পরিচয়ের বিষয়ে কেবল 'রুমা' নাম ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা এরইমধ্যে ফেসবুকে রুমার ছবিসহ পরিচয় জানতে চেয়ে পোস্ট করেছেন। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমরা তার পরিবারের খোঁজ বের করতে পারব।
মানবাধিকার সংস্থা সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটির জেলা সভাপতি আলমগীর আল আমিন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে আমরা ভয়েজ অব ঝিনাইগাতীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। পরবর্তীতে সরেজমিনে গিয়ে দেখে এসেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা তার পরিবারের সন্ধ্যান চেয়ে পোস্ট করেছি। সবার স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় 'রুমা' তার ঘরে ফিরে যাবে এমনটাই আশা করছি।
বিজ্ঞাপন
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী খাদিজাতুল জান্নাত বলেন, রুমা মানসিকভাবে অসুস্থ। অনেক কিছুই সে মনে রাখতে পারে না। সকালের কথাও সে বিকেলে বলতে পারে না। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। স্থানীয়রা মাঝে মধ্যে রুমাকে খাবার দিলে খুব তৃপ্তি নিয়েই সে খায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আল আমিন বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই এই পরিত্যক্ত অ্যাম্বুলেন্সেই এক প্রকার মানবেতর জীবন যাপন করছেন রুমা। তার বয়স ৩০ থেকে ৩৫ হবে। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও তার প্রয়োজন মানষিক চিকিৎসা সেবা, যা আমাদের এখানে নেই। আমরা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তার পরিবারের পরিচয় বের করার জন্য জানিয়েছি। তার প্রকৃত চিকিৎসাও প্রয়োজন। উন্নত চিকিৎসা সেবা পেলেই হয়তো রুমা আবারও সুস্থ হয়ে উঠবে। বিষয়টি জেলা হাসপাতালের ওসিসি ডিপার্টমেন্টকে জানানো হয়েছে।
এদিকে শেরপুর জেলা হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেলের (ওসিসি) জেলা কর্মকর্তা অমিত শাহরিয়ার বাপ্পী বলেন, আমি ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পরিচয়হীন ওই নারীর সম্পর্কে জেনেছি। ওই নারী মানসিক প্রতিবন্ধী বলে চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন। যেহেতু আমরা অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করি, আমাদের পক্ষ থেকে ওই নারীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব। তবে শেরপুরে যেহেতু সেইফ হোম নেই, তাই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা প্রদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ হতে পরামর্শ ও সহযোগিতা পেলে তাকে চিকিৎসা করানো সম্ভব।
ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বছির আহমেদ বাদল বলেন, এই নারীর ঠিকানা ও স্বজনদের খোঁজা হচ্ছে। আমরা আশা করছি দ্রুতই স্বজনদের পাব।
প্রতিনিধি/এসএস