আকাশজুড়ে হাজার হাজার ফুট পুরু মেঘের স্তর ভেদ করে বিমান অনায়াসেই চলাচল করতে পারে। কিন্তু শীতকালের কয়েক ফুট উচ্চতার ঘন কুয়াশায় কেন স্থবির হয়ে পড়ে দেশের বিমানবন্দরগুলো? সাধারণ চোখে মেঘ ও কুয়াশা একই রকম মনে হলেও, বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে এই দুটির প্রভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্প্রতি ঘন কুয়াশায় রানওয়েতে দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় প্রতিদিনের শিডিউল বিপর্যয় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি আকাশপথের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
মেঘ ও কুয়াশার মৌলিক পার্থক্য
বিজ্ঞাপন
মেঘ থাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে, যা বিমানের টেক-অফ বা ল্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে খুব একটা বাধা সৃষ্টি করে না। কিন্তু কুয়াশা হলো ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন ঘনীভূত জলকণা। বিমান যখন রানওয়েতে নামে বা উড্ডয়ন করে, তখন পাইলটকে মাটির খুব কাছাকাছি থেকে রানওয়ে দেখতে হয়। কুয়াশা ঠিক এই জায়গাতেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

কুয়াশা কেন বিমানের জন্য বেশি বিপজ্জনক?
১. রানওয়ে ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ (RVR): আকাশে ওড়ার সময় পাইলট সেন্সর এবং রাডারের ওপর নির্ভর করতে পারেন, যাকে বলা হয় 'ইন্সট্রুমেন্টাল ফ্লাইং'। কিন্তু রানওয়েতে চাকা ছোঁয়ানোর ঠিক আগের মুহূর্তে পাইলটকে নিজের চোখে রানওয়ের 'সেন্ট্রাল লাইন' এবং লাইটগুলো দেখতে হয়। মেঘ আকাশে থাকায় রানওয়ে দেখা যায়, কিন্তু কুয়াশা সরাসরি রানওয়ের ওপর আস্তরণ তৈরি করে দৃশ্যমানতা বা 'ভিজিবিলিটি' শূন্যে নামিয়ে আনে।
বিজ্ঞাপন
২. ল্যান্ডিং সিদ্ধান্তের সংকট: একজন পাইলট যখন বিমান অবতরণ করান, তখন একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা (Decision Height) থেকে রানওয়ে পরিষ্কার দেখতে না পেলে তিনি ল্যান্ডিং বাতিল করতে বাধ্য হন। কুয়াশা অত্যন্ত ঘন ও নিচু হওয়ায় এই উচ্চতায় পৌঁছানোর পরও রানওয়ে দৃশ্যমান হয় না, যা মেঘের ক্ষেত্রে সাধারণত ঘটে না।

৩. টেকনিক্যাল সীমাবদ্ধতা (CAT-III সিস্টেম): ঘন কুয়াশার মধ্যেও বিমান নামানোর জন্য 'ক্যাট-৩' (CAT-III) প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। এটি এমন এক পদ্ধতি যেখানে পাইলটকে রানওয়ে না দেখলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিমান অবতরণ করানো যায়। তবে আমাদের দেশের সব বিমানবন্দরে বা সব বিমানে এই প্রযুক্তি না থাকায় সামান্য কুয়াশাতেই ফ্লাইট বাতিল বা ডাইভার্ট করতে হয়।
আরও পড়ুন: বিমান আকাশে উড়তে ১ ঘণ্টায় কত লিটার জ্বালানি লাগে?
৪. বিভ্রান্তিকর আলো (Light Scattering): মেঘের ভেতরে আলোর প্রতিফলন একরকম হলেও, কুয়াশার জলকণাগুলো রানওয়ের উজ্জ্বল আলোগুলোকে চারদিকে ছড়িয়ে দেয় (Scattering)। এতে পাইলট রানওয়ের সঠিক অবস্থান বুঝতে বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন, যা বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

পরিণাম: শিডিউল বিপর্যয় ও ঝুঁকি
প্রতিদিন ভোরে ও রাতে ঘন কুয়াশার কারণে রানওয়ের দৃশ্যমানতা ৬০০ থেকে ৮০০ মিটারের নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে পাইলটরা জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে বিমান বসিয়ে রাখছেন বা পাশের অন্য কোনো দেশে অবতরণ করাচ্ছেন। এতে জ্বালানি খরচ বাড়ছে এবং হাজার হাজার যাত্রী অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেও, আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগই পারে কুয়াশার এই চাদর ভেদ করে আকাশপথকে সচল রাখতে।
এজেড

