মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

স্মৃতিময় ঈদযাত্রা

ইয়াকুব আলী 
প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১০:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

গত বৃহস্পতিবার ছিল ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস। আগের দিন বুধবার ছিল স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের ছুটি। ফ্রেঞ্চ লিভ হিসেবে  অনেকেই গতকাল অফিসে আসেননি। নিতান্ত বাধ্য হয়ে যারা এসেছিল তারাও ছিল ১১টার মধ্যে ভেগে যাওয়ার তালে। পাঠক সমাবেশে গিয়েছিলাম একটা প্রকাশনার খোঁজ করতে। গাড়িতে করে আগারগাঁও থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই শাহবাগে। ঢাকা এখন অনেকটাই ফাঁকা। ঢাকাকে যারা বাঁচিয়ে রাখেন, সচল রাখেন তাদের বেশির ভাগ ঘরমুখী হওয়ায় একটা বিষণ্ন পরিবেশ বিরাজ করছে শহর জুড়ে। এদিকে ২৭ রমজানের পর মসজিদগুলোও ফাঁকা হতে শুরু করেছে। কিছুটা প্রাণবন্ত আছে শপিং সেন্টারগুলো।

নানা কারণে স্মরণীয় ঈদযাত্রা আমার নেই বললেই চলে। এ কারণে লোকেদের আনন্দময় বাড়ি ফেরা দেখে ঈর্ষান্বিতই হই। পথে নানা হয়রানি-হেনস্থার কারণে ইদানীং ঈদ মৌসুমে চলাচলে সন্ত্রস্ত থাকি। বহু বছর বাড়ির বাইরে থাকার কারণে ঈদে বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছি অনেক।  তার মধ্যে ১৯৮৭ সালের ঈদযাত্রা এখনো হৃদয়ে দোলা দেয়। 


বিজ্ঞাপন


আমি তখন ক্লাস নাইনে। রমজান পুরোটা কাটাই তেজগাঁওয়ে-বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে। আমাদের আশাভরসার বাতিঘর বড় ভাই আশরাফুল আলমের সদ্যই ঢাকায় চাকরি হয়েছে গ্লাস এন্ড সিরামিক ইনস্টিটিউটে। এর আগে তিনি নারায়ণগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় ও ময়মনসিংহের খাগডহরে কিছুকাল চাকরি করেছিলেন।  সেবার বড়ভাই আমাকে হালকা সবুজ রঙের একটি শার্ট কিনে দিয়েছিলেন। আর আমি আনন্দ হলের বিপরীতে ফুটপাত থেকে ইলাষ্টিকবহুল একটি বেল্ট কিনেছিলাম ১০ টাকায়।

যাহোক, ঈদযাত্রায় ফেরত আসি। কমলাপুর থেকে ট্রেন ছাড়ল সাড়ে নয়টা কি দশটায়। সম্ভবত এটি ছিল ‘ঈশা খাঁন এক্সপ্রেস’ নামের মেইল ট্রেন অথবা ঈদের বিশেষ ট্রেন। আন্তঃনগর তখনো চালু হয়নি। এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস তো চালু হয়েছিল তার পরের বছর ১৯৮৮ সালে। 

সে সময়ের ট্রেনযাত্রা মানে ভয়াবহ গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি। সিটের কয়েক গুণ যাত্রী একেকটি কামরায় উঠত। আর ছাদে উঠতো সমসংখ্যক। বাসের কথা অবশ্য বলতে পারব না। ভৈরব হয়ে রাস্তাটি ছিল চলাচলের অনুপযোগী। কাপাসিয়ার টোক হয়ে রাস্তাটি হয় আরও ১৬/১৭ বছর পর। ময়মনসিংহ হয়ে যে বাসগুলো ঢাকায় যাতায়াত করত সেগুলোর চেহারা-অবয়ব ভালো ছিল। সকাল সাড়ে সাতটা আটটার ‍দিকে দুটো বাস ছেড়ে যেত মানসী সিনেমা হলের কাছ থেকে। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে তখনো ব্রিজ হয়নি।

আগেভাগে স্টেশনে পৌঁছার ফলে ট্রেনে বসার জায়গা অবশ্য পেয়েছিলাম। বড়ভাই কিনে নিলেন একটি ইত্তেফাক পত্রিকা। ঈদের আগের দিন হওয়ায় পত্রিকাতে ঈদের বিশেষ ক্রোড়পত্র ছিল। তখনকার দিনে এখনকার মতো ঢাউস সাইজের ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হতো না। ক্রোড়পত্রে আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের একটি গল্প ছিল। বস্তির একটি তরুণীকে নিয়ে লেখা। তখন থেকেই আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের লেখা আমার পছন্দ। 


বিজ্ঞাপন


তখনো হাফ টিকিটেই চলাচল করি। ভাড়া ছিল সম্ভবত সাড়ে আট টাকা। রোজার দিনে হওয়ায় হকারদের উৎপাত ছিল কম। তবে লুলা ল্যাংড়া ভিখারি উঠেছিল প্রচুর পরিমাণে। ভিখারিদের গানের সুর মন্দ ছিল না:  ‘বিসমিল্লাহ বলিয়া আল্লাহ/ যে ভাই করে দান/আমার আল্লাহ নবীজির নাম।’ / ‘জানের সদকা মালের যাকাত/ কইরা  যান গো দান/ আমার আল্লাহ নবীজির নাম।’
ঢাকা ছেড়ে ট্রেন ভৈরবের আগে তেজগাঁও, টঙ্গী, আড়িখোলা, ঘোড়াশাল, নরসিংদী, আমিরগঞ্জ, খানাবাড়ি, শ্রীনিধি, মেথিকান্দা এসব স্টেশনে থেমেছিল। তখনো বিমানবন্দর স্টেশন নির্মিত হয়নি। এ রুটে আমার কাছে প্রধান আকর্ষণ ছিল ঘোড়াশাল ব্রিজ ও ভৈরব রেলওয়ে জংশন। আন্তঃনগর উৎপাত না থাকায় দীর্ঘ সময় থেমে থাকার কোনো বিষয় ছিল না। ভৈরব গিয়ে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে কিশোরগঞ্জের পথে  ট্রেন থামে কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, সরারচর, মানিকখালি স্টেশনে। গচিহাটায় আমরা নেমে যাই। 

সে যুগে আমাদের এলাকার যেসব মানুষ পায়ে হেঁটে স্টেশনে যাতায়াত করত তারা গচিহাটাকেই প্রেফার করত। রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। রিকশাও খুব পাওয়া যেত না। আমাদের বাড়ি থেকে কিশোরগঞ্জ স্টেশন ৭ মাইল। গচিহাটার দূরত্ব মাইল পাঁচেকের বেশি হওয়ার কথা না। বড়ভাই বেশিরভাগ সময় গচিহাটায় নেমে ধুলদিয়া বাজার থেকে বাজার করে বাড়ি যেতেন। আমার জীবনে অবশ্য এই একবারই গচিহাটায় নামা। 

বিকেল তিনটা-সাড়ে তিনটা হবে। প্রচণ্ড রোদ। ভয়াবহ গরম। তৃষ্ণায় ছাতি ফাটার অবস্থা। হবেই তো জ্যৈষ্ঠ মাস যে। দুই ভাই হাঁটা শুরু করি। দুপাশে প্রায় জনশূন্য মাঠঘাট খা খা করছে। ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর জালিয়ায় পৌঁছে বড় ভাই থেকে গেলেন মুসলেহ উদ্দিন বিএসসির খোঁজে। বাকি মাইলখানেক পথ একা একাই বাড়ি ফিরি। মানুষের বাড়ির পাশের জমিতে চাষ করা পাটক্ষেতের বাড়ন্ত ডাঁটাগুলোর কমনীয়তা এখনো চোখে ভাসে। পাশের বাড়ির চাচিআম্মা বলতেন, পাটক্ষেতের ডাঁটা সুস্বাদু হয়। 

সকলের ঈদযাত্রা আনন্দময় হোক। দীর্ঘ ছুটি থাকায় এবারের ঈদযাত্রা স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে বলে আশা করা যায়। আমাদের দেশে ঈদের ছুটি দীর্ঘ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই ঈদে গ্রামীণ অর্থনীতি নিশ্চিতভাবেই চাঙ্গা হবে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা - ঈদ মুবারক।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর