images

নারী ও শিশু / হেলথ

নবজাতকদের এনআইসিইউতে ‘ফাঙ্গাল সুপারবাগ’ আতঙ্ক, গবেষকদের সতর্কবার্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

১০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১৯ এএম

হাসপাতাল-সম্পর্কিত সংক্রমণ (এইচএআই) জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। এসব সংক্রমণের মধ্যে ক্যান্ডিডা অরিস নামের এক ধরনের ছত্রাক (ফাঙ্গাস) সম্প্রতি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ক্যান্ডিডা সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি মাক্রোবায়োলজি স্পেকট্রাম জার্নালে প্রকাশিত আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্ডিডা অরিস বাংলাদেশে নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ছড়িয়ে পড়ছে।

এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে আইসিডিডিআর,বি বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সহযোগিতায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) অর্থায়নে বাংলাদেশের দুটি টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালে। রোববার (৯ নভেম্বর) এ তথ্য জানায় আইসিডিডিআরবি।

প্রতিষ্ঠানটির মতে, ক্যান্ডিডা অরিস এমন এক ধরনের ছত্রাক— যা মানুষের ত্বকে কোনও লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই অবস্থান করতে পারে এবং দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে। প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই অবস্থান থেকে সংক্রমণে পরিণত হয়, সাধারণত রক্তের মতো জীবাণুমুক্ত অংশের মাধ্যমে এটি  অনুপ্রবেশে করে, যা রোগটিকে অনেক বেশি প্রাণঘাতী করে তোলে।

অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশে ক্যান্ডিডা অরিসজনিত রোগে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মৃত্যুর হার প্রায় ৭০ শতাংশ লক্ষ্য করা গেছে। দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, গুরুতর অসুস্থ রোগী এবং অপরিণত নবজাতকদের মধ্যে এটি বিশেষভাবে বিপজ্জনক। ফলে এনআইসিইউ-তে থাকা অনেক নবজাতক উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। এই ছত্রাকটি প্রায়শই একাধিক অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী, যার কারণে সিডিসি একে ২০১৯ সালে ‘অতি জরুরি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করে।

দীর্ঘ সময় হাসপাতালে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে টিকে থাকা, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং উচ্চ মাত্রার অসুস্থতা ও মৃত্যুর ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় ক্যান্ডিডা অরিসকে ‘হাসপাতাল-সম্পর্কিত সুপারবাগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গবেষকরা ঢাকার একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি নবজাতকদের মধ্যে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। ভর্তি হওয়ার সময় এবং পরবর্তী সময়ে তারা রোগীদের ত্বকে বা রক্তে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ বা অবস্থানের (কলোনাইজেশন) জন্য পরীক্ষা করেন, যাতে হাসপাতালের ভেতরে সংক্রমণ ছড়ানোর ধরন বোঝা যায়।

৩৭৪ জন রোগীর মধ্যে ৩২ জন (৯ শতাংশ) ত্বকে ক্যান্ডিডা অরিস বহন করছিল এবং একজন (০ দশমিক ৩ শতাংশ) রোগীর রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এই ৩২ জনের মধ্যে ১৪ জন (৪৪ শতাংশ) ভর্তি হওয়ার সময়ই আক্রান্ত ছিল এবং ১৮ জন (৫৬ শতাংশ) ভর্তি হওয়ার পর সংক্রমিত হয়। ভর্তি হওয়ার সময় আক্রান্ত ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জন অন্য হাসপাতাল বা ওয়ার্ড (যেমন প্রসূতি ওয়ার্ড) থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিল, কেবল একজন এসেছিল বাড়ি থেকে। সংক্রমিত ৩২ জনের মধ্যে ৭ জন (২২ শতাংশ) মারা যায়, যার মধ্যে রক্ত সংক্রমিত বাচ্চাটিও ছিল। ফলাফলগুলো ইঙ্গিত করে যে, এনআইসিইউ-এর ভেতরে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ নিয়মিত ঘটছে, কারণ অর্ধেকের বেশি রোগী ভর্তি হওয়ার পরই সংক্রমিত হয়।

এই ফলাফল আইসিডিডিআর,বি-র আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে নতুনভাবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোনও রোগীর মধ্যেই লোকালয় থেকে ক্যান্ডিডা অরিস পাওয়া যায়নি। এতে আরও জোরালোভাবে প্রমাণিত হয় যে, এই ছত্রাকটি হাসপাতালের পরিবেশেই টিকে থাকে এবং সেখান থেকেই ছড়ায়। 

1
যেসব রোগীদের মধ্যে ক্যান্ডিডার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তাদের ৮১ শতাংশ জন্ম সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে হয়েছিল। ছবি: প্রতীকী 

বর্তমান গবেষণায় ক্যান্ডিডা অরিস এর মাত্র ৩টি (৯ শতাংশ) আইসোলেট একাধিক ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী ছিল, তবে ৮২ শতাংশ ছিল ফ্লুকোনাজোল প্রতিরোধী, যা রক্তে ছত্রাকজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রথম সারির ওষুধ।

উল্লেখযোগ্যভাবে, যেসব রোগীদের মধ্যে ক্যান্ডিডার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তাদের ৮১ শতাংশ জন্ম সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে হয়েছিল। গবেষকরা ধারণা করছেন— সিজারিয়ান ডেলিভারির পর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অবস্থান করার ফলে ক্যান্ডিডা অরিস-এর সংস্পর্শে আসার সুযোগ বেড়ে যায়।

আইসিডিডিআর,বি-র সহযোগী বিজ্ঞানী ও সংক্রামক রোগ বিভাগের এএমআর রিসার্চ ইউনিটের প্রধান ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন, ‘এই গবেষণা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে গুরুতর অসুস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাচ্চাদের মধ্যে এই ‘সুপারবাগ’-এর সংক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এটি প্রশাসনিকভাবে ও পলিসি লেভেলে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রথম ধাপ।’

গবেষকরা এনআইসিইউ এবং অন্যান্য হাসপাতাল পরিবেশে এই ছত্রাকের টিকে থাকা ও ছড়ানো রোধে কার্যকরী ক্লোরিন-ভিত্তিক জীবাণুনাশক দিয়ে নিয়মিত হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিষ্কার করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হাত ধোয়ার অভ্যাস উন্নত করার সুপারিশ করেছেন।

গবেষকরা বলেন, ‘এনআইসিইউ-তে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণের ধারাবাহিক নজরদারি চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে আক্রান্ত হওয়া নবজাতকদের শনাক্ত করে দ্রুত আলাদা রাখা যায়, ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যায় এবং দ্রুত অ্যান্টি-ফাঙ্গাল চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।’

এসএইচ/ক.ম