আমিরুল ইসলাম
০৮ মার্চ ২০২৪, ০২:২৫ পিএম
‘সাম্যের গান গাই –
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই নারীকে মূল্যায়ন করেছেন। নারী তার মেধা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে সভ্যতার সব অগ্রগতি এবং উন্নয়নে করেছে সমঅংশীদারিত্ব।
একটা সময়ে নারীদের ঘর থেকে বের হওয়াই কঠিন ছিল। নারীরা থাকত গৃহবন্দি। চিত্র বদলে গেছে। নারী এখন আর ঘরে বসে থাকে না। পেশাজীবনের নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায়ে এখন নারীর পদচারণা। পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে চলেছে নারী। অর্থনীতিতে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। বাণিজ্য, উৎপাদন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা– সব ক্ষেত্রে অদম্য নারী।
স্বাধীন বাংলাদেশের গত হওয়া পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে দেশের নারীরা। এ ৫০ বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে নারীরা। মোটা দাগে দেখতে গেলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নারীর সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।
গ্রামীণ অর্থনীতি, নগর অর্থনীতি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাজনীতি, প্রশাসন সবখানে নারীর পদচারণা লক্ষণীয়। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ সচিবদের মধ্যে এখন নারী রয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবেও কাজ করছেন। সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি শান্তিরক্ষা মিশনেও নারী আছেন। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি হিসেবে নারীরা নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, ভাইস চ্যান্সলর হিসেবে, আইন পেশা ও গণমাধ্যমে- এক কথায় সর্বক্ষেত্রে নারীর দৃপ্ত পদচারণা দৃশ্যমান। ক্রীড়াতেও এ দেশের নারীর সাফল্য রচিত হয়েছে। সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলাসহ সর্বক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীর সাফল্য এখন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও আলোচিত বিষয়। এসব কারণে বাংলাদেশকে নারীর অগ্রযাত্রার একটি রোল মডেল ধরা হয়ে থাকে। তাই জাতিসংঘ থেকে শুরু করে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনও এ দেশের নারীর জয়গান করেছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে নারী হিস্যা ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন। মোট শ্রমশক্তিতে ৪ কোটি ২২ লাখ পুরুষ আর নারী ১ কোটি ৮৭ লাখ।
>> আরও পড়তে পারেন
পুরুষদের বিরুদ্ধে কিছু বলে ভোট হারাতে চাই না: প্রধানমন্ত্রী
শ্রমবাজারে নারীর একটা বড় অংশই নিম্ন মজুরির ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। বাকিরা শিক্ষকতা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা পেশায় যুক্ত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীসহ বিভিন্ন উচ্চ পদেও দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। তবে শ্রমবাজারে নারীর একটা বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। যেমন কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। গবেষণা বলছে, কৃষিতে ২১টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজই নারীরা সম্পাদন করে। সম্ভবত সে জন্যই বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশের কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে। কর্মজীবী নারীদের আরেকটি বড় অংশ পোশাক শিল্পে কাজ করে। মোট দেশজ উৎপাদনে এ খাতের অবদান ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। মোট রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। পোশাক খাতে কাজ করছেন ৪০ লাখ শ্রমিক। তার ৫৯ দশমিক ১২ শতাংশই নারী।
বাংলাদেশে জিডিপিতে পুরুষ এবং নারীর অবদান প্রায় সমান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের অবদান বলা যায় সমান সমান।
তবে নারীর এই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো তার প্রতি সহিংসতা। আইন-কানুন, আদালতের রুলিং- কোনো কিছু দিয়ে এর লাগাম টানা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটে নারীর চলাচল আমরা নির্বিঘ্ন করতে পারছি না, কর্মস্থলে, গণপরিবহনে নিরাপত্তা দিতে পারছি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। অনেক ঘটনা দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাচ্ছে, গণমাধ্যমেও প্রকাশিত কিংবা প্রচারিত হচ্ছে না। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নিজের ঘরেই নিগৃহীত হন। এতেই বোঝা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতা কীভাবে লক্ষণীয়। নারীর এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে এক বিশাল প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে, অনেক নীতি আছে, আইন আছে। সম্প্রতি ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনও করা হয়েছে। তারপরও সহিংসতার লাগাম টানা যাচ্ছে না। এখানে শুধু মূল্যবোধের অবক্ষয় নয়, অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিও বহুলাংশে দায়ী।
>> আরও পড়তে পারেন
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ
নারী আন্দোলনের ইতিহাসে আজ এক গৌরবময় দিন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এখন ৮ মার্চ পালন করা হলেও প্রথম নারী দিবস পালন করা হয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯০৯ সালের এই দিনে নিউইয়র্কে নারী দিবসের আয়োজন করেছিল সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা।
১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেন হেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে নিয়মিত নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যদিও ১৯১১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয় ১৯ মার্চ। ১৯১৪ সালে বেশ কয়েটি দেশ ৮ মার্চ নারী দিবস পালন করে। ১৯৭৫ সালে দিনটিকে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। এই সূত্রে নারী দিবস প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের সেলাই কারখানাগুলোর নারী শ্রমিকরা তাদের নায্য অধিকারের দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাদের দাবির অন্যতম দাবি ছিল দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রমের পরিবর্তে ৮ ঘণ্টার কাজ। এই বিক্ষোভে হাজার হাজার নারী শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসে এবং পুলিশের অত্যাচারের শিকার হন। এছাড়াও অগণিত শ্রমিক গ্রেফতার হন।
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, আফগানিস্তান, রাশিয়া, কিউবা, ইউক্রেনসহ অনেক দেশেই রয়েছে ৮ মার্চ সরকারি ছুটি। এছাড়াও চীন, নেপাল, মাদাগাস্কারেও এদিন শুধু নারীদের ছুটি দেওয়া হয়। আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া ও সার্বিয়াসহ অনেক দেশে ৮ মার্চ নারী দিবসের পাশাপাশি ‘মা’ দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। নারী ও মা দুই দিবস মিলিয়ে দেশগুলোতে সরকারি ছুটি থাকে।
/এএস