নিজস্ব প্রতিবেদক
০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:১১ পিএম
ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনলাইন মাধ্যমগুলোতে সহিংসতার ঘটনা। যার বড় অংশই নারীরা। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়েছে। যা ২০২১ সালে ছিল ৫০ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে শতকরা ১৩ শতাংশ।
শনিবার (২ ডিসেম্বর) সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ‘নারী ও কন্যার প্রতি সাইবার সহিংসতা: বাস্তবতা ও করণীয়’ বিষয়ে তরুণদের সাথে মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন। তিনি বলেন, ই-মেইলের মাধ্যমে হয়রানি, সাইবার বুলিয়িং, সাইবার স্টকিং, সাইবার পর্নোগ্রাফি, সাইবার অপবাদ, মরফিং, ইমেইল স্পুফিং এবং নানা ধরনের সাইবার সহিংসতা ঘটছে। সাইবার অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে উপাদানগুলো মূলত কাজ করে সেগুলো হলো: ভিকটিমদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলির সহজলভ্যতা, ব্যবহারকারীদের অজ্ঞতা এবং উদাসীনতা, ভিকটিমের দায়, একজনের ব্যক্তিগত তথ্য অন্য প্রোফাইলের নিচে ব্যবহার এবং প্রযুক্তি বিকাশের সাথে আইনি পদক্ষেপের ফাঁক-ফোকর।
২০২২ সালে ৫১৪ জন অনলাইন ব্যবহারকারীর ওপর পরিচালিত অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে জানানো হয়, ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়। যা ২০২১ সালে ছিল ৫০ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে তা বেড়েছে ১৩ শতাংশ। যারা অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে ৬৭ দশমিক ৮১ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১-৫ বার, ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ নারী ৫-১০ বার এবং ১০ দশমিক ৩ শতাংশ এক বছরে ১০ বারের বেশি শিকার হয়েছেন। এসব নারীর মধ্যে ৪৭ শতাংশ ফেসবুকে এবং ৩৫ শতাংশ মেসেঞ্জারে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এছাড়া ইন্সটাগ্রাম ৬ দশমিক ১১ শতাংশ, আইএমও ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ, হোয়াটসআপ ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং ইউটিউবে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
ড. কাবেরী গায়েন আরও বলেন, ২০০৬ সালে দ্য ইনফরমেশন, কমিউনিকেশেন অ্যান্ড টেকনোলজি (আইসিটি) অ্যাক্ট এবং ২০১৩ সালে সংশোধনী আইনটি হয়। এই আইনের ৫৭ এবং ৬৬ ধারায় নারীর বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধে শাস্তির কথা বলে। তবে যে প্রশ্নটি উঠেছিল, সেটা হলো নারীকে ইমেইলের মাধ্যমে হয়রানিমূলক বার্তা পাঠানো, সাইবার স্টকিং, সাইবার পর্নোগ্রাফি, সাইবার মানহানি, মরফিং, ইমেইল স্পুফিং, সাইবার বুলিইং- এসব বিষয়ে বিচার কি সাইবার ট্রাইব্যুনালে হবে না কি ক্রিমিনাল কোর্টে হবে। দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ ক্রিমিনাল কোর্টে এসব অভিযোগের বিচার হয়েছে। কাজেই নারীরা এসব অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাননি। এ অবস্থায়, সুরাহার পথ দুটি। প্রথমটি আইনি ব্যবস্থায় জোরদার করা। দ্বিতীয়টি সমাজ মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন সাধন। পরিবর্তন আনতে হবে সাইবার পরিসর ব্যবহারকারীর আচরণে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) শ্যাম সুন্দর শিকদার বলেন, সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারের অনেক ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। সাইবার দুনিয়া একটি মুক্ত জায়গা, যেখানে নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই দিতে হবে। ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অভিভাবকদের বাচ্চাদের ইন্টারনেটের ব্যবহার মনিটরিং করতে হবে, তাদের ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে মেধা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে।
এ সময় তিনি বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার সময় বিটিআরসির নির্দেশ অনুসারে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল গাইডলাইন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারদের থেকে সংগ্রহ করার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান।
শ্যাম সুন্দর শিকদার বলেন, সোশাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক এদেশে নেই। এরপরও বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিটিআরসির উদ্যোগে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ৩৫ হাজার আপত্তিকর কনটেন্ট ফেসবুক সরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং গণমাধ্যম নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করছে। এটি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাইবার ট্রাইবুনাল, ঢাকার বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) এ এম জুলফিকার হায়াত বলেন, সাইবার স্পেসে বেশিরভাগ নারী ভিকটিম হয় প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতার অভাবে। তবে অপরাধ প্রমাণের জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ না থাকার কারনে অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। এটি প্রতিরোধে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহারের আগে পরিষ্কার ধারণা নিতে হবে; ফেসবুক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে; একটি নির্দিষ্ট বয়সের আগে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া থেকে অভিভাবকদের বিরত থাকতে হবে।
এ সময় তিনি নারী ও কন্যার প্রতি সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে একাধিক সিমকার্ড ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং টিকটক, ইমো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনি নীতিমালা তৈরির ওপর জোর দেন।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (প্রটেকশন অ্যান্ড প্রটোকল) আমেনা বেগম বলেন, মাঠ পর্যায়ে ৬৫৯টি পুলিশি থানা আছে। এসব থানার কেস তদন্ত কর্মকর্তাদের সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এতে ঢাকা সিটির চাইতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়া ঝুঁকি বেশি। আন্ডার রিপোর্টিংয়ের জন্য এক্সপ্লয়টেশন বেশি হচ্ছে। পুলিশের সাইবার সাপোর্ট টিমে মাত্র ১৫-১৬ জন জনবল রয়েছে যারা ৭০ হাজার অভিযোগ পেয়েছে। সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে সাইবার সাপোর্ট টিমের জনবল বাড়াতে হবে। ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর এ সচেতনতা শিশুবেলা থেকেই তৈরি করতে হবে।
এ সময় সরকারি-বেসরকারি ও তরুণদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সাইবার ক্রাইম মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এমএইচ/জেবি