images

তথ্য-প্রযুক্তি

শ্রীনিবাস রামানুজন কেন বিখ্যাত?

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক

২২ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:১৭ পিএম

Failed to load the video

যারা গণিতকে ভালোবাসেন তাদের সবাই শ্রীনিবাস রামানুজনকে চেনেন। যিনি অসামান্য প্রতিভাবান একজন ভারতীয় গণিতবিদ। গণিতশাস্ত্রে তার অবদান অপরিসীম। গণিতকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অসামান্য উচ্চতায়। 

ইতিহাসখ্যাত এই গুণীজনের আজ জন্মদিন। ১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের তাঞ্জোর জেলার ইরেভদ শহরে রামানুজনের জন্ম হয়। তিনি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন। তার পিতা কে শ্রীনিবাস ইয়েঙ্গার ছিলেন শহরের একটি কাপড়ের দোকানের হিসাবরক্ষক। তার মা কোমালাটাম্মাল গৃহিণী ছিলেন। অর্থ উপার্জনের জন্য ঘরকন্নার পাশাপাশি স্থানীয় এক মন্দিরে গান গাইতেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্না মহিলা। 

রামানুজন স্বল্পায়ু হলেও গণিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে গেছেন। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় তিনি গণিতের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে গাণিতিক বিশ্লেষণ, সংখ্যাতত্ত্ব, অসীমধারা ও আবৃত্ত ভগ্নাংশ শাখায়, গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। 

তার রেখে যাওয়া নোটবুক বা ডায়েরি থেকে পরবর্তীতে আরও অনেক নতুন সমাধান পাওয়া গেছে। ইংরেজ গণিতবিদ জি এইচ হার্ডি রামানুজনকে অয়েলার ও গাউসের সমপর্যায়ের গণিতবিদ মনে করেন। 

ramanujanরামানুজন ১০ বছর বয়সে গণিতের সঙ্গে পরিচিত হোন। তাকে এস এল লোনি লিখিত ‘ত্রিকোণমিতি’ বইটি দেওয়া। ১২ বছরের মধ্যে তিনি ঐ পুস্তকের বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন করেন। এমন কি তিনি নিজে কিছু উপপাদ্য আবিষ্কার করেন এবং স্বতন্ত্রভাবে অয়েলারের এককত্ব পুনরাবিষ্কার করেন।

বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি গণিতে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়ে পুরস্কার ও প্রশংসা লাভ করেন। ১৭ বছর বয়সে রামানুজন বার্নোলির সংখ্যা ও অয়েলার-মাসেরনি ধ্রুবকের ওপর নিজের গবেষণা সম্পন্ন করেন। কুম্বাকোটম সরকারি কলেজে পড়ার জন্য বৃত্তি পেলেও অ-গণিতীয় বিষয়ে ফেল করার কারণে তার বৃত্তি বাতিল হয়ে যায়। এরপর তিনি অন্য একটি কলেজে নিজের গাণিতিক গবেষণা শুরু করেন। এই সময় জীবন ধারণের জন্য তিনি মাদ্রাজ বন্দর ট্রাস্টের মহাহিসাবরক্ষকের কার্যালয়ে কেরানি পদে যোগ দেন।

রামানুজন সাধারণত কম কথা বলতেন এবং মনে হতো তিনি কিছুটা ধ্যানমগ্ন থাকতেন। তার অসাধারণ প্রতিভা স্কুল কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে এবং তার প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে বৃত্তি দেওয়া হয়। তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বিভিন্ন গাণিতিক উপপাদ্য, গণিতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। 

রামানুজন ম্যাজিক স্কোয়ার গঠনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এরপর তিনি জ্যামিতিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর কাজ শুরু করেন। বৃত্তের বর্গসম্পর্কীয় তার গবেষণা পৃথিবীর বিষুবরৈখিক পরিধির দৈর্ঘ্য নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে নির্ণীত বিষুবরৈখিক পরিধির দৈর্ঘ্য এবং প্রকৃত মানের পার্থক্য মাত্র কয়েক ফুট ছিল। জ্যামিতির সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে তিনি বীজগণিতের দিকে দৃষ্টিপাত করেন।

ramanujan১৬ বছর বয়সে রামানুজন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও জুনিয়র শুভ্রামানায়াম বৃত্তি লাভ করে কুম্ভকোনাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু গণিতের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার ফলে পরের পরীক্ষায় ইংরেজিতে অকৃতকার্য হন এবং তার বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি কুম্ভকোনাম ত্যাগ করে প্রথমে বিশাখাপত্তনম এবং পরে মাদ্রাজ যান। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ফার্স্ট এক্সামিনেশন ইন আর্টস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং অকৃতকার্য হন। তিনি আর এই পরীক্ষা দেননি। এরপর কয়েক বছর তিনি নিজের মত গণিত বিষয়ক গবেষণা চালিয়ে যান।

১৯০৯ সালে রামানুজন বিবাহ করেন। কিন্তু তার কোন স্থায়ী কর্মসংস্থান ছিলনা। প্রয়োজনের তাগিদেই তিনি স্বভাবের বিপরীতে জীবিকা অন্বেষণের চেষ্টা চালাতে থাকেন। এ সময় তার ঘনিষ্ঠ একজন একটি পরিচয়পত্র দিয়ে চাকরির সুপারিশ করে তাকে মাদ্রাজ শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে নিলোর শহরের কালেক্টর দেওয়ান বাহাদুর রামচন্দ্র রাও-এর কাছে প্রেরণ করেন। 

রামচন্দ্র রাও গণিতের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। রামানুজনের দুটি নোটবুক তার সকল গাণিতিক সূত্রের প্রতিপাদন ও এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় লিপিবদ্ধ ছিল।

রামানুজনের অনেক বন্ধু ও হিতৈষীর প্রচেষ্টায় ১৯১৩ সালের মে মাসে মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের কেরানির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং একটি বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়। ঠিক এমনি সময়ে তিনি ক্যামব্রিজ থেকে একটি আমন্ত্রণ পান। 

ক্যামব্রিজ এর আমন্ত্রণে ইংল্যান্ডে আসার অল্পদিন পরই রামানুজন ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ পেয়ে যান। এই সময় মাদ্রাজ থেকে প্রাপ্ত বৃত্তির পরিমাণ ছিল বার্ষিক ২৫০ পাউন্ড। তার ৫০ পাউন্ড দেশে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য দিতে হত। এছাড়া ট্রিনিটি কলেজ থেকে ভাতা বাবদ ৫০ পাউন্ড পেতেন। 

১৯১৭ সালের বসন্তকালের প্রথমে রামানুজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে ক্যামব্রিজের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। এরপর তিনি আর কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন নি। তাকে ওয়েলস, ম্যালটক এবং লন্ডন শহরের স্বাস্থ্যনিবাসে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক বছর তার শারীরিক কোন উন্নতি দেখা যায়নি। 

এই সময় রামানুজন রয়েল সোসাইটি-র সদস্য নির্বাচিত হন। গবেষণা কাজে অধিক মনোযোগ দেওয়ার ফলে তার সবচেয়ে মূল্যবান উপপাদ্যগুলো এই সময় আবিষ্কৃত হয়।

তিনি নির্বাচিত ট্রিনিটি ফেলো ছিলেন। ১৯১৯ সালে রামানুজন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। কিছুকাল যক্ষ্মারোগে ভোগার পর ১৯২০ সালের ২৬ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

ramanu janরামানুজনের নোটখাতা

প্রথম থেকেই রামানুজন তার সকল গবেষণালব্ধ ফলাফল তার নোটখাতায় লিখে রাখতেন। কিন্তু তিনি কোন প্রতিপাদন লিখতেন না। ফলে এমন একটি ধারণার জন্ম হলো যে, রামানুজন তার তত্ত্বসমূহ প্রমাণ করতে সমর্থ ছিলেন না। গণিতবিদ ব্রুস বেন্ডিট রামানুজন এবং তার নোটখাতা সম্পর্কিত আলোচনায় একথা বলেছেন যে, রামানুজন তার তত্ত্বসমূহ প্রমাণ করতে পারতেন কিন্তু কোন কারণে তিনি সেটা আনুষ্ঠানিকতায় রূপ দিতেন না। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।

রামানুজন আর্থিক ভাবে সচ্ছল ছিলেন না, আর তখন কাগজের মূল্য ছিল চড়া। তাই রামানুজন শ্লেটে লিখে কোন তত্ত্ব প্রমাণ করতেন এবং নোটখাতায় শুধুমাত্র ফলাফল লিখে রাখতেন। রামানুজনের প্রথম নোটখাতার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৩৫১। এটি ১৬ টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ছিল এবং কিছু অগোছালো পৃষ্ঠাও পাওয়া যায়। তার দ্বিতীয় নোটখাতার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ২৫৬। অধ্যায় ছিল ২১ টি এবং এতে ১০০ টি অগোছালো পৃষ্ঠা ছিল। তৃতীয় নোটখাতাতেও এরকম ৩৩ টি অবিন্যস্ত পৃষ্ঠা ছিল। তার এসব নোটখাতা পরবর্তীতে গণিতবিদদের গবেষণায় বিরাট অবদান রাখে। 

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

এজেড