তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক
১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৪:১৯ পিএম
শক্তির উৎস জ্বালানি নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তার শেষ নেই। তাইতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের তাগিদ তাদের। কিন্তু এ থেকে আশানুরূপ শক্তি মেলে না। তাই বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখেন এমন এক জ্বালানি উৎসের, যা কোনোদিন ফুরাবে না। এমনকি এর ব্যবহারে পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না। অবশেষে নতুন এক উদ্ভাবন আশার আলো দেখিয়েছে। নিউক্লিয়ার ফিউশন বা পারমাণবিক সংযুক্তির মাধ্যমে অনাদিকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
মঙ্গলবার মার্কিন বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন , এরকম প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথে বড় বাধা তারা উতরে গিয়েছেন। ফলে পরমাণুর সংযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরেই চেষ্টা করছিলেন কীভাবে এরকম একটা যুৎসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা যায়।
দুইটি পরমাণুর সংযুক্তি বা ফিউশন ঘটাতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হচ্ছিল –ফিউশন থেকে পাওয়া যাচ্ছিল তার চেয়ে অনেক কম শক্তি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন এই সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া গেছে।
অনেকেই জানেন পরমাণু হচ্ছে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা যা তিনটি আরো ক্ষুদ্র উপাদান দিয়ে গঠিত – ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি হয় পরমাণুর কেন্দ্র আর তার চারদিকে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন।
এই পরমাণুর কেন্দ্রটাকে যদি ভাঙা যায়, তাহলে যে শক্তি দিয়ে নিউট্রন আর প্রোটন একসাথে লেগে আছে, তা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আনে।
আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী এই শক্তির পরিমাণ বিপুল। অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ পদার্থের পরমাণু ভেঙে ফেললেও তা থেকে যে শক্তি বেরিয়ে আসবে তার পরিমাণ হবে প্রচণ্ড।
এই পরমাণু ভাঙার প্রক্রিয়াকে বলে 'ফিশন'। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে পারমাণবিক বোমা-সবগুলোর মূল ব্যাপারটা একই ।
পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে এই ফিশন ঘটানো হয় নিয়ন্ত্রিতভাবে – যাতে সৃষ্ট তাপ দিয়ে পানি গরম করে বাষ্পীয় টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। আর বোমার ক্ষেত্রে ফিশন হয় অনিয়ন্ত্রিত তাই তা হয়ে ওঠে এক ভয়ংকর মারণাস্ত্র।
পারমাণবিক ফিউশন জিনিসটা হচ্ছে ফিশনের ঠিক উল্টা। যার অর্থ 'জোড়া লাগা।'

এখানে পরমাণুকে ভাঙা হয় না, বরং হাইড্রোজেন গ্যাসের দুটি পরমাণুকে অতি উচ্চ তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে জোড়া লাগানো হয়। যার ফলে নিউক্লিয়াসের ভেতরের বিপুল পরিমাণ শক্তি বাইরে বেরিয়ে আসে।
সূর্য এবং অন্যান্য তারা থেকে যে প্রচণ্ড শক্তি অবিরাম নির্গত হচ্ছে , তা ঘটছে এই ফিউশন প্রক্রিয়ার ফলেই।
এই শক্তি ব্যবহার করে যদি বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করা যায় – তাহলে প্রায় কোন পরিবেশগত ক্ষতি না করেই অনিঃশেষ পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির (এলএল এনএল) বিজ্ঞানীরা বলেন, তারা এমন এক পদ্ধতি বের করতে পেরেছেন যাতে ফিউশন ঘটাতে যে পরিমাণ শক্তি লাগছে – পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি শক্তি।
জ্বালানি বা বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই নিউক্লিয়ার ফিউশনকে মনে করা হয় এমন এক বহুকাঙ্খিত লক্ষ্য। যা অনেকেই সম্ভব করতে চেয়েছেন কিন্তু কেউ পারেননি। কেননা, ফিশন প্রযুক্তিতে আজকালকার যেসব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে, তাতে প্রচুর পরিমাণ তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন হয় – যা নিরাপদভাবে মজুদ করে না রাখলে বিপদের কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের ফলে অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন সম্ভব এবং এর ফলে যে বর্জ্য তৈরি হয় তার পরিমাণ সামান্য, আর তা খুব বেশি দিন তেজষ্ক্রিয় থাকে না। এর ফলে কোন গ্রিনহাউজ গ্যাসও নির্গত হয় না, ফলে জলবায়ু পরিবর্তনকেও তা ত্বরান্বিত করে না।
এই গবেষণা দলের সদস্য এল এল এন এল-এর পরিচালক ড. কিম বাডিল বলেন, ‘এটি এক ঐতিহাসিক অর্জন। গত ৬০ বছর ধরে হাজার হাজার লোক এই প্রয়াসে অবদান রেখেছেন, এবং এ পর্যন্ত আসতে অনেক উদ্ভাবনীক্ষমতার প্রয়োজন হয়েছে।’
মনে রাখতে হবে যে পদার্থের পরমাণুর দুই উপাদান প্রোটন আর নিউট্রনকে যে শক্তি একসাথে বেঁধে রেখেছে, তা এক প্রচণ্ড শক্তি।
ফিউশন প্রযুক্তিতে হাইড্রোজেন ব্যবহার হয় – কারণ হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা মৌলিক পদার্থ এবং এর পরমাণুর গঠনও সবচেয়ে সরল। সাধারণতঃ একটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটি মাত্র প্রোটন আর একটি ইলেকট্রন থাকে – খুব বিরল ক্ষেত্রে একটি দুটি নিউট্রন থাকতে পারে। কিন্তু দুটি হাইড্রোজেনের পরমাণুকে জোড়া লাগানো এবং তাকে সেই যুক্ত অবস্থায় ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন। এতদিন পর্যন্ত কোন পরীক্ষাতেই সে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করে তার চেয়ে বেশি শক্তি বের করে আনা সম্ভব হয়নি।

শত শত কোটি ডলারের পরীক্ষা
ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি হচ্ছে সাড়ে তিনশ কোটি ডলারের এক পরীক্ষা প্রকল্প।
পরীক্ষাটা হচ্ছে এই রকম – একটা গোলমরিচের দানার সমান একটা ক্যাপসুলের মধ্যে সামান্য পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাস ভরা হয়।
এর পর একটা অত্যন্ত শক্তিশালী লেজার রশ্মি দিয়ে একে উত্তপ্ত করা হয় এবং চাপ প্রয়োগ করা হয়।
এই লেজার প্রচণ্ড শক্তিশালী। এটা প্রয়োগ করায় ক্যাপসুলটি এত গরম হয়ে যায় যে তার তাপমাত্রা হয় ১০০,০০০,০০০ বা ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস । এ তাপমাত্রা সূর্যের কেন্দ্রস্থলের চেয়েও বেশি।
তাপের সাথে প্রয়োগ করা হয় চাপ। এ চাপের পরিমাণ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের চাইতে ১০,০০০ কোটি গুণ বেশি।
এই প্রচণ্ড তাপ ও চাপের ফলে ক্যাপসুলটির ভেতরে থাকা হাইড্রোজেনের পরমাণুগুলো একটি আরেকটির সাথে জোড়া লেগে যেতে থাকে, আর সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসতে থাকে তাদের ভেতরের শক্তি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রতিরক্ষা কর্মসূচির উপ-প্রশাসক ড. মার্ভিন অ্যাডামস এই আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করে বলেন, ‘এই ল্যাবরেটরির লেজারগুলো হাইড্রোজেন ক্যাপসুলের ওপর ২.০৫ মেগাজুল (এমজে) পরিমাণ শক্তি নিক্ষেপ করেছে এবং তার পর ফিউশন থেকে যে শক্তি পাওয়া গেছে তার পরিমাণ ৩.১৫ মেগাজুল।’
ফিউশন এনার্জি ইনসাইটস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ড. মেলানি উইন্ড্রিজ বলেন, ‘সূর্য কেন এত উজ্জ্বল তা যেদিন বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন সেদিন থেকেই তারা ফিউশনের কথা ভাবছিলেন। আজকের এই ফলাফল আমাদেরকে সত্যি সত্যিই এ প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহারের পথে তুলে দিয়েছে।’

কবে এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে?
শত শত কোটি ডলারের এই পরীক্ষায় যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়েছে তা দিয়ে ১৫-২০ কেটলি পানি গরম করা যাবে মাত্র – এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ পরীক্ষায় যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে – তার চেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়েছে।
এটা একটা সাফল্য ঠিকই, কিন্তু লেজারগুলোকে চালাতে যে শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে তা এই হিসেবে ধরা হয়নি। তার পরিমাণ কিন্তু হাইড্রোজেন থেকে পাওয়া শক্তির চেয়ে বেশি।
তার মানে হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে এ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হলে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে, আর এর খরচও কমিয়ে আনতে হবে।
সূত্র: বিবিসি
এজেড