সালমান ইসলাম
১৯ জুন ২০২৩, ০৯:০৮ এএম
টানটান উত্তেজনা নিয়ে দর্শকরা ঘিরে রেখেছে ১০ মিটার বাই সাড়ে ১২ মিটারের একটি আয়তাকার ক্ষেত্র। দুই পাশে সাতজন করে খেলোয়াড়। এরমধ্যে একজন একবার দম নিয়ে হা-ডু-ডু-ডু-ডু করতে করতে বিপরীত পাশে থাকা দলের দিকে এগিয়ে গেল। দম থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ছুঁয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরতে হবে তার। দম আর শক্তির এই খেলায় সে কি ঘরে ফিরতে পারবে? না কি প্রতিপক্ষের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে নিজেই খেলা থেকে ছিটকে পড়বে?
আমরা সবাই জানি, এটি বাংলাদেশের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী হাডুডু বা কাবাডি খেলা। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েই জনপ্রিয় একটি খেলা।
তবে ইট-কাঠের নগরে খেলার জায়গা সংকুচিত হয়ে আসা আর নাগরিক ব্যস্ত জীবনের কারণে শহরে তো বটেই, গ্রামেও ঐতিহ্যবাহী ও উত্তেজনাপূর্ণ কাবাডি বা হাডুডু খেলা এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না।
এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা নিঃসন্দেহে ক্রিকেট। এছাড়া ফুটবল, টেনিস, হকি, ভলিবল, হ্যান্ডবল, গলফের মতো আন্তর্জাতিক খেলাগুলোও দেশে একদম কম জনপ্রিয় নয়। দেশীয় খেলা কাবাডির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, বলি খেলা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে কাবাডিকে জাতীয় খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন।
জাতীয় খেলার মর্যাদা আর ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার বাইরে গ্রামাঞ্চলে তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিসরে কাবাডিতে কেন ভালো করতে পারছে না বাংলাদেশ? ১৯৯০, ১৯৯৪ ও ২০০২ সালের এশিয়ান গেমস আসরের কাবাডি (পুরুষ) খেলায় রৌপ্যপদক আর ১৯৯৮ ও ২০০৬ সালের আসরে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী বাংলাদেশ, ২০১০ থেকে পরের আসরগুলোয় প্রথম চারেই থাকতে পারেনি।
কাবাডি বিশ্বকাপেও ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো কাবাডি বিশ্বকাপ শুরু হয়। সেবার ভারত চ্যাম্পিয়ন, ইরান রানারআপ এবং বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান লাভ করে। ২০০৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ কাবাডিতেও ভারত চ্যাম্পিয়ন, ইরান রানারআপ এবং বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান লাভ করে। এর ১১ বছর পর ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বিশ্বকাপ কাবাডিতে বাংলাদেশ প্রথম চারটি দলের মধ্যেও ছিল না। সেবারও ভারত চ্যাম্পিয়ন, ইরান রানারআপ হয়েছিল।
২০১৬ সালের দীর্ঘ ৮ বছর পর আগামী বছর (২০২৪ সালে) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পরবর্তী কাবাডি বিশ্বকাপ। ইতিমধ্যে সেই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
এশিয়ান গেমস কাবাডি ও কাবাডি বিশ্বকাপসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ নিয়মিত অংশগ্রহণ করলেও ফলাফল হিসাব করলে দেখা যাবে তেমন দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই।
দেশে দক্ষ ও পেশাদার কাবাডি খেলোয়াড় কেন গড়ে উঠছে না- এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন অর্থায়ন আর পৃষ্ঠপোষকতা সংকটের মতো নানান কারণের কথা।
অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত সাম্প্রতিক সময়ে কাবাডির মতো আঞ্চলিকভাবে জনপ্রিয় খেলাগুলোকে বিশ্ব পর্যায়ে তুলে ধরতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে পেশাদার কাবাডি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। ২০১৪ সালে ভারত প্রথমবারের মতো ‘প্রো কাবাডি লিগ’ আয়োজন করে। আইপিএল, বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের মতোই জনপ্রিয়তা অর্জন করে প্রো কাবাডি লিগ। করোনা মহামারির কারণে একবছর বাদ দিয়ে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই আয়োজিত হয়েছে তুমুল জনপ্রিয় এই টুর্নামেন্ট।
আগামী ৭ অক্টোবর শুরু যাচ্ছে প্রো কাবাডি লিগের দশম আসর। এর মাধ্যমে ভারতে একদিকে আবার জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে কাবাডি, অন্যদিকে দক্ষ কাবাডি খেলোয়াড় বের হয়ে আসছেন। এতে অংশ নিয়ে কৌশল ও নৈপুণ্য দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন অনেক তরুণ খেলোয়াড়। ফলে স্থানীয় পর্যায়েও এখন গড়ে উঠছে কাবাডি দল ও ক্লাব।
বাংলাদেশে জাতীয় খেলা কাবাডির জনপ্রিয়তা বাড়াতে প্রতিবেশী ভারতের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা যেতে পারে। এতে জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে খেলোয়াড়রা বের হয়ে আসার সুযোগ পাবে। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সেরাদের বাছাই করার সুযোগ পাবে ফেডারেশন। এতে করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার মতো জাতীয় দল গঠন করা আরও সহজ হবে। একদিকে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, অন্যদিকে জাতীয় খেলাকেও আমরা দিতে পারব যথাযোগ্য মর্যাদা।
এসটি/