images

ফুটবল

স্পেন থেকে কাতার, বিশ্বকাপে ফুটবলের বিবর্তন

স্পোর্টস ডেস্ক

২০ নভেম্বর ২০২২, ০২:২৮ পিএম

আজ রাতেই পর্দা উঠছে ফিফা বিশ্বকাপ-২০২২ এর। চার বছর পরপর হওয়া বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আসর এবার বসতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমির। বিশ্বকাপ যতই ঘনিয়ে আসছে সমর্থকদের মাঝে বাড়ছে উত্তেজনা।

প্রতিটি বিশ্বকাপের বল নিয়ে আলাদা এক দুর্বলতা কাজ করে ভক্তদের মাঝে। যা দেখার জন্য চার বছর ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ফুটবলবিশ্ব। ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপ থেকে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ, প্রতিটি বিশ্বকাপের বলেই আছে বাহারি বৈশিষ্ট্য। সঙ্গে বলেও এসেছে বিস্ময়কর বিবর্তন। প্রতিটি বলের উপকরণ, নকশা ও কার্যকারিতায় এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। জেনে নেওয়া যাক, ১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপ থেকে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে ব্যবহৃত প্রতিটি বলের ইতিহাস ও নানা জানা-অজানা তথ্য।

১৯৮২

স্পেন বিশ্বকাপের জন্য অ্যাডিডাস বানিয়েছিল ম্যাচ বল ট্যাঙ্গো-এসপানা। পলিইউরেথিনের প্রলেপ দেওয়া বলটির প্যানেল সেলাই করার সুতোতেও দেওয়া হয়েছিল রাবারের প্রলেপ। এই ট্যাঙ্গো-এসপানা বলটিই ছিল বিশ্বকাপে ব্যবহৃত হওয়া শেষ চামড়ার বল। তবে বলটি ত্রুটিমুক্ত না হওয়ায় অনেক ম্যাচে বল পরিবর্তন করতে হয়েছিল।

বিশ্বকাপে ব্যবহৃত শেষ চামড়ার বল, ট্যাঙ্গো-এসপানা।

১৯৮৬

মেক্সিকো বিশ্বকাপের ম্যাচ বলে অ্যাডিডাস এনেছিল এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। সেই প্রথম বিশ্বকাপ খেলা হয়েছিল সম্পূর্ণ সিন্থেটিক লেদারে তৈরি বল দিয়ে। মেক্সিকো বিশ্বকাপের অফিসিয়াল বলটির নাম ছিল ‘আজটেকা’। মেক্সিকো বিশ্বকাপেই ম্যাচ বলের শরীরে প্রথম পড়েছিল আয়োজক দেশের সংস্কৃতির প্রভাব। আজটেকা বলের বহিরঙ্গে ফুটে উঠেছিল সভ্যতার স্থাপত্য ও ম্যুরালের কাজ।

আজটেকা

১৯৯০

ইতালি বিশ্বকাপের জন্য অ্যাডিডাস বানিয়েছিল উন্নতমানের ম্যাচ বল ‘ইট্রুস্কো ইউনিকো। বলের উপরিভাগে থাকা সিন্থেটিক স্তরের নিচে ছিল পলিইউরেথিন ফোমের আরও একটি স্তর। ফলে বলটিকে সম্পূর্ণ জলনিরোধক করা সম্ভব হয়েছিল। ম্যাচ বলের আগের প্রজন্মগুলোর থেকে এই বলটি ছিল অনেক দ্রুতগামী। ম্যাচ বলটির নাম ও নকশা তৈরিতে ছিল প্রাচীন ইতালির ইট্রুস্কান সভ্যতার স্পর্শ। কারণ ম্যাচ বলটির প্যানেলে ছিল হুংকাররত তিনটি সিংহের মুখ। যেটি ছিল ইস্ট্রুস্কান সভ্যতার প্রতীক।

ইট্রুস্কো ইউনিকো

১৯৯৪

আমেরিকা বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস নিয়ে এসেছিল উল্কাগতির বল কোয়েস্ট্রা। ১৯৯৪ সাল ছিল অ্যাপোলো-১১ মিশনের রজতজয়ন্তী বর্ষ। যে মহাকাশ অভিযানে চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখেছিল মানুষ। তাই ম্যাচ বলটির বহিরঙ্গে ছিল আমেরিকার মহাকাশ প্রযুক্তি, উচ্চগতির রকেট ও আমেরিকার নক্ষত্র অভিযানের ছোঁয়া।

কোয়েস্ট্রা ছিল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ বল, যেটির ওপরে পলিস্টাইরিন ফোমের প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল। ফলে বল হয়েছিল অনেক নরম। বিশ্বকাপারদের পায়ের আঘাতে রকেটের গতিতে ছুটতে শুরু করেছিল বল। প্রচুর গোল হয়েছিল আমেরিকা বিশ্বকাপে। কিন্তু অখুশি ছিলেন গোলকিপারেরা। বলটি শূন্যে থাকার সময় আচমকা দিক পরিবর্তন করায়, তাদের প্রচুর গোল হজম করতে হয়েছিল।

১৯৯৮

ফ্রান্স বিশ্বকাপে ফুটবল প্রেমীরা দেখেছিল প্রথম বহুবর্ণের বল। এই বিশ্বকাপের জন্য অ্যাডিডাস বানিয়েছিল উন্নতমানের বল ট্রাইকলর। বলটির বহিরঙ্গে ফরাসি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময় ব্যবহৃত সাদা লাল নীল রঙ এবং ফ্রান্সের সনাতন প্রতীক মোরগ ফুটে উঠেছিল বলের নকশায়।

২০০২

জাপান বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস নিয়ে এসেছিল ম্যাচ বল ‘ফিভারনোভা’। সেই প্রথম বিশ্বকাপ খেলা হয়েছিল ত্রিকোণ ডিজাইনের বল দিয়ে। চারটি সোনালি ষড়ভূজের মধ্যে আঁকা ছিল চারটি সবুজ রঙের ত্রিভুজ। ফিভারনোভা বলটিতে ছিল মোট ১১ টি স্তর। এর মধ্যে একটি স্তর ছিল সিন্থেটিক ফোমের। যে স্তরটির মধ্যে ভরে দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্যাস বেলুন। বলের বাইরের স্তরটি পলিইউরেথিন ও রবার দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বলটি অত্যন্ত হালকা হওয়ায়, ভীষণ ভাবে সমালোচিত হয়েছিল। বিশ্বকাপের নক আউট স্টেজে অনেক অঘটন ঘটানোর জন্য দায়ী করা হয়েছিল ফিভারনোভা বলটিকে।

২০০৬

জার্মানি বিশ্বকাপের ম্যাচ বল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল অ্যাডিডাসের ১৪ প্যানেলের বল টিমগায়েস্ট। জার্মান ভাষায় ‘টিমগায়েস্ট’ শব্দটির অর্থ ‘টিম স্পিরিট’। সেই প্রথম বিশ্বকাপের প্রত্যেকটি ম্যাচের জন্য নির্দিষ্ট বল বরাদ্দ করা হয়েছিল। ম্যাচ বলের গায়ে লেখা হয়েছিল ম্যাচের তারিখ, দুটি দলের নাম, স্টেডিয়ামের নাম ও ম্যাচ শুরু হওয়ার সময়। বিশ্বকাপ ফাইনালের জন্য তৈরি করা হয়েছিল সোনালি রঙের টিমগায়েস্ট বল।

টিমগায়েস্ট বলটির নকশা বানিয়েছিল অ্যাডিডাস ও মোল্টেন কর্পোরেশন। বলটি বানিয়েছিল অ্যাডিডাস। বলটিতে কিছু বিশেষত্ব ছিল। ভিজে গেলেও ভারী হবে না। শূন্যে ভাসার সময় গতিপথ পরিবর্তন করবে না। এছাড়াও বলের গায়ে সেই প্রথম দেখা গিয়েছিল ট্রফির ছবি।

২০১০

দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস এনেছিল প্রথম ৮ প্যানেলের বল জাবুলানি। বলের নকশায় ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় পতাকার রঙগুলি। বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি খেলা হয়েছিল একটি বিশেষ বল, ‘দ্য গোল্ড জাবুলানি’ দিয়ে। 

জাবুলানি ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে সমালোচিত বল। কারণ শূন্যে থাকাকালীন বলটি অস্বাভাবিক আচরণ করত। আচমকা স্যুইং করে বিভ্রান্ত করে দিত খেলোয়াড়দের। ব্রাজিলের গোলকিপার জুলিও সিজার বিরক্ত হয়ে জাবুলানিকে বলেছিলেন সুপার মার্কেটের বল। ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার ফ্যাবিয়ানো জাবুলানির নাম দিয়েছিলেন ‘ভুতুড়ে বল’।

২০১৪

ব্রাজিল বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস এনেছিল পলিইউরেথিনের ৬টি প্যানেল দিয়ে তৈরি করা ম্যাচ বল ‘ব্রাজুকা’। সাত রঙা বলটির সঠিক নাম বেছে নেওয়ার জন্য ব্রাজিলের ১০ লক্ষ ফ্যানকে নিয়ে একটি ভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। ভোটারদের সামনে রাখা হয়েছিল তিনটি নাম, বসা নোভা, কার্নাভালেস্কা ও ব্রাজুকা। শেষ নামটিই বেছে নিয়েছিলেন ৭৭.৮% ভোটার। কারণ ব্রাজিলিয়ানরা কথ্য ভাষায় নিজেদের ব্রাজুকা বলেন।

২০১৮

রাশিয়া বিশ্বকাপে নতুন ভাবে বিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছিল ১৯৭০ সালে হওয়া মেক্সিকো বিশ্বকাপের ম্যাচ বল ‘টেলস্টার’। মেক্সিকো বিশ্বকাপের ম্যাচ বল টেলস্টার ছিল ৩২ প্যানেলের। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপের জন্য অ্যাডিডাস এনেছিল ৬ প্যানেলের ম্যাচ বল টেলস্টার ১৮। প্যানেলগুলি জোড়া হয়েছিল উচ্চমানের আঠা দিয়ে। বলটির নকশা করেছিল অ্যাডিডাস। কিন্তু বলটি বানিয়েছিল পাকিস্তানের শিয়ালকোটের কোম্পানি ফরোয়ার্ড স্পোর্টস। চিন ও পাকিস্তানের কারখানায়।

রাশিয়া বিশ্বকাপের নক আউট পর্যায়ের ম্যাচগুলি খেলা হয়েছিল টেলস্টার-মেচতা নামের বল দিয়ে। বিশ্বকাপের আগে অ্যাডিডাস জানিয়েছিল, এটিই তাদের বানানো সবচেয়ে সেরা বল। তবে অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের ম্যাচে বল ফেটে গিয়েছিল। বলটি সমস্যা তৈরি করেছিল আরও কিছু ম্যাচে।

২০২২

কাতার বিশ্বকাপ খেলা হবে বিশ্বকাপের ইতিহাসের প্রথম হাইটেক বল ‘আল-রিহলা’ দিয়ে। ৪২০ গ্রামের বলটির ভেতর লাগানো আছে সেন্সর। বুদ্ধিমান বল ধরিয়ে দেবে অফসাইড। জানিয়ে দেবে সঠিক ফ্রি কিক পয়েন্ট। আরবী ভাষায় আল-রিহলা শব্দটির অর্থ ‘দ্য জার্নি’। সিন্থেটিক লেদার দিয়ে তৈরি, ২০ প্যানেলের বলটির গায়ে ফুটে উঠেছে কাতারের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ঐতিহ্যবাহী নৌকা ও জাতীয় পতাকার ছবি।

অ্যাডিডাস দাবি করেছে, আল-রিহলা হতে চলেছে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে গতিশীল বল। কথাটি শুনে চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন অংশগ্রহণকারী দলগুলোর গোলকিপারেরা। কারণ বিশ্বকাপের আঙিনায় সবচেয়ে মহার্ঘ জিনিসটি হল ‘গোল’। সেই গোল এনে দেওয়ার জন্যেই ৯২ বছর ধরে এক নাগাড়ে বিবর্তিত হয়ে চলেছে বিশ্বকাপের ম্যাচ বল।

এসটি/এফএইচ