সালমান ইসলাম
২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৮ এএম
পার্থ স্টেডিয়ামের ধুলোবালিতে দাঁড়িয়ে যখন ব্রেন্ডান ডাগেট প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট জার্সি গায়ে জড়াবেন, তখন সেটা শুধু একটা ম্যাচের শুরু নয় একটা জাতির ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। ৩১ বছর বয়সী এই লম্বা চওড়া কুইন্সল্যান্ডের ছেলে, যিনি কয়েকদিন আগেও কাঠের টুকরো কেটে ঘর বানাতেন, আজ অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডেবিউ করছেন।
জোশ হ্যাজেলউডের আঘাতের কারণে খালি জায়গাটা পূরণ করতে এসে তিনি শুধু টিমে স্থান পাননি, বরং অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ইতিহাসে একটা মাইলফলক গড়ে তুলছেন। স্কট বোল্যান্ডের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুজন আদিবাসী (ইন্ডিজেনাস) খেলোয়াড় একই একাদশে, এমনটা আগে কখনো হয়নি। ডাগেটের কথায়, “এটা পুরোটাই একটা বোনাস।” কিন্তু এই বোনাসের পিছনে লুকিয়ে আছে একটা অসাধারণ গল্প-স্বপ্ন, পরিশ্রম আর জীবনের অপ্রত্যাশিত মোড়।
ব্রেন্ডান ডাগেটের জীবন যেন দুটো অর্ধেক গল্পের মতো। এক অংশে তিনি ক্রিকেটের মাঠে দৌড়ে বেড়ান, আরেক অংশে কার্পেন্টারের হাতুড়ি আর গাঁথুনির সাথে লড়াই করেন। টুবুম্বা শহরের এই ছেলে ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট পাগল, কিন্তু জীবিকার দায়িত্ব তাকে ক্লাব ক্রিকেটের বাইরে যেতে দেয়নি। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কোনো প্রতিনিধিত্বমূলক দলে খেলেননি। পরিবারের সাপোর্টে ক্লাব লেভেলে দাপট দেখিয়ে কুইন্সল্যান্ডের চোখে পড়েন, এবং ২০১৭-১৮ সিজনে শেফিল্ড শিল্ডে প্রথম ক্লাস ডেবিউ করেন।
কিন্তু ক্রিকেটকে কখনো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য পেশা মনে করেননি তিনি। “আমি সবসময় জানতাম, ক্রিকেট আমার স্বপ্ন, কিন্তু কাজ হবে কার্পেন্টারির,” বলেছেন ডাগেট এক সাক্ষাৎকারে। অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ শুরু করে তিনি ঘর বানানোর কাজ রপ্ত করেন, যা আজ তার ক্রিকেট জীবনের সাথে মিলে যায়। “একটা ঘর বানাতে ধৈর্য লাগে, একটা উইকেট নিতে-দিতে লাগে। দুটোই ধাপে ধাপে এগোতে হয়,” তার কথায়।
এই দ্বৈত জীবন চালাতে গিয়ে ডাগেট কখনো অভিযোগ করেননি। সকালে ক্রিকেট প্র্যাকটিস, দুপুরে কাজের মাঠ। কিন্তু মনের কোণে স্বপ্নটা জ্বলজ্বল করত অস্ট্রেলিয়ার ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ গায়ে দিয়ে খেলা। ২০১৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে স্কোয়াডে ডাক পড়লেও ডেবিউ হল না। তখনই তিনি বুঝলেন, স্বপ্নের পথটা লম্বা। তাই ক্রিকেটকে ‘হবি’ রেখে কার্পেন্টারির কাজ চালিয়ে যান।
কিন্তু ভাগ্যের খোলস ভাঙল চলতি বছরের মার্চ মাসে। শেফিল্ড শিল্ড ফাইনালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে গিয়ে তিনি একারই ১১টা উইকেট নেন, কুইন্সল্যান্ডকে হারিয়ে ট্রফি তুলে দেন। সেই পারফরম্যান্সে ৩৩ উইকেট নিয়ে সিজনের সেরা বোলার হয়ে ওঠেন, এভারেজ মাত্র ২৪.১৫। এবার অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলে ফিরে এসে ৬ উইকেট নেওয়ার পর অ্যাশেজ স্কোয়াডে নাম উঠল।

অ্যাশেজ ২০২৫-২৬ সিরিজের আগে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাম্পে ছিল চোটের ছায়া। জোশ হ্যাজেলউড, প্যাট কামিন্সের মতো তারকা খেলোয়াড় ছুটি নিয়েছে। এমন সময় ডাগেটের নাম উঠল, যিনি মিচেল স্টার্ক আর স্কট বোল্যান্ডের সঙ্গে পেস আক্রমণের দায়িত্ব সামলাবেন। অস্ট্রেলিয়ার অস্থায়ী অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ ঘোষণা করলেন, “জেক ওয়েদারাল্ড আর ব্রেন্ডান ডাগেট দুজনেই ডেবিউ করবে। এটা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।” পুরো একাদশটা এরকম- উসমান খাজা, জেক ওয়েদারাল্ড, মার্নাস লাবুশেন, স্টিভ স্মিথ (অধিনায়ক), ট্রাভিস হেড, ক্যামেরন গ্রিন, অ্যালেক্স ক্যারি (উইকেটরক্ষক), মিচেল স্টার্ক, নাথান লায়ন, ব্রেন্ডান ডাগেট, স্কট বোল্যান্ড।
এই দল নির্বাচন শুধু কৌশলগত নয়, ঐতিহাসিক। ডাগেট আর বোল্যান্ড দুজনেই আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান। প্রথমবার টেস্টে দুজন ইন্ডিজেনাস খেলোয়াড় একসাঙ্গে, যা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের জন্য একটা বড় লাফ। “এটা শুধু আমার জন্য নয়, আমার সম্প্রদায়ের জন্য,” বলেছেন ডাগেট। সোভিত্রিয়ান লিগ্যেন্ড ব্রেট লি পর্যন্ত বলেছেন, “ডাগেটকে নিউ বল দিন, স্কট বোল্যান্ডের আগে। তার স্পিড আর সুইং ইংল্যান্ডকে কাঁপাবে।” এক্সে-এ (পূর্বের টুইটার) ফ্যানরা উচ্ছ্বসিত: “স্কট বোল্যান্ড আর ডাগেটের জুটি, ইতিহাস গড়ে তোলার মতো!”
যখন সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করল, অ্যাশেজে খেলার অনুভূতি কী, ডাগেট হেসে বললেন, “এটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছিলাম, কাঠমিস্ত্রির কাজ করছিলাম এবং হঠাৎ এই সুযোগ। এটা বোনাস, পুরোপুরি বোনাস!” তার এই সরলতা যেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের আত্মার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে তারকারা হয়তো চিৎকার করে উঠবে, কিন্তু ডাগেট শান্ত।
কারণ তিনি জানেন, এই মুহূর্তটা কতটা অদ্ভুত। ৫০টা ফার্স্ট-ক্লাস ম্যাচে ১৯০ উইকেট নিয়ে (এভারেজ ২৬.৪৬, বেস্ট ৬/১৫) তিনি প্রমাণ করেছেন, স্বপ্ন শুধু দেখাই নয়, বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়। লিস্ট এ ক্রিকেটে তার ৪০টা উইকেট আছে, এবং টি-টোয়েন্টিতে ২৯টা। কিন্তু টেস্ট? সেটা ছিল অপ্রাপ্যের মতো। নটিংহামশায়ার কাউন্টি ক্লাবের সঙ্গে তার পুরনো সংযোগও মজার। ২০১৮ সালে ট্রেন্ট ব্রিজে বোল্যান্ডের সাথে আদিবাসী একাদশে খেলেছিলেন, আজ সেই জুটি অ্যাশেজে। “আমরা তখনও ট্রেইলব্লেজার ছিলাম,” বলে ক্লাবের পোস্ট।
প্রত্যেকের মনে একটা কুড়েঘর থাকে স্বপ্নের। কেউ তাকে ইস্পাতের ভবনে পরিণত করে, কেউ শুধু দেখে। ডাগেট তার স্বপ্নকে কাঠের টুকরো দিয়ে গড়েছিলেন, আর আজ সেটা অ্যাশেজের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট শুরু হচ্ছে ২১ নভেম্বর, যেখানে ডাগেটের হাতুড়ি উইকেটের মতো আঘাত করবে কি না, সেটা দেখার।
(সূত্র: ইএসপিএন ক্রিকইনফো, রয়টার্স, এবিসি নিউজ, ডেইলি মেইল, ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ফক্স স্পোর্টস)