images

স্পোর্টস / ক্রিকেট

ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব ভুলে ক্রিকেটে সুদিন ফিরবে কবে

সালমান ইসলাম

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:০৭ পিএম

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট দ্বৈরথ বিশ্বের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ক্রীড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর একটি। এই দুই দেশের ম্যাচ শুধু খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তেজনার একটি প্রতিফলন। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে ক্রিকেটে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ প্রায় বন্ধ, এবং শুধুমাত্র আইসিসি ইভেন্ট বা এশিয়া কাপের মতো বহুপাক্ষিক টুর্নামেন্টেই এই দুই দল মুখোমুখি হয়।

দুই দেশের মধ্যে ক্রিকেট দ্বন্দ্বের শিকড় গভীরভাবে রাজনৈতিক। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক শুরু হয়। কাশ্মীর ইস্যু, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, এবং ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ এই বৈরিতাকে আরও তীব্র করে। সাম্প্রতিক সময়ে, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা এবং ২০২৫ সালের এপ্রিলে জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও নাজুক করে তুলেছে। এই ঘটনার পর ভারত সিন্ধু চুক্তি বাতিল, আটারি-ওয়াগা সীমান্ত বন্ধ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে, ভারতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তানে খেলতে যাওয়া বন্ধ করেছে, এবং দ্বিপাক্ষিক সিরিজও গত ১২ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। 

চলতি বছরে পহেলগাম হামলার পর ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীরের সাম্প্রতিক মন্তব্যে এই দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, “সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কোনো ক্রিকেট সম্পর্ক ঠিক নয়।” এই মনোভাব ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) অবস্থানকেও প্রতিফলিত করে, যারা সরকারের নির্দেশনা ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট খেলতে রাজি নয়।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা উত্তেজনা বৃদ্ধি, বিশেষ করে কাশ্মীরের পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর আরও বাড়ে। ভারত যেমন পাকিস্তানের মাটিতে খেলতে আসতে চাই না, তেমনি কঠোর হয় পাকিস্তানও। যার ফলে দুই দেশের মধ্যে সমঝতা ফেরাতে ২০২৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সময় আইসিসি এই দুই দেশের জন্য বৈশিক আসর গুলো ২০২৭ পর্যন্ত নিরপক্ষ ভেন্যুতে খেলার বিষয়টি অনুমোদন করে।

india_pakistan_national_ যার প্রতিফলন দেখা যায় ২০২৫ এশিয়া কাপের আসরে। আয়োজক দেশ ভারত হলেও আরব আমিরাতের মাটিতে হচ্ছে এশিয়া কাপে এবারের আসর। তবে সম্প্রতি পহেলগাম হামলার উত্তাপ ছড়িয়েছে আরব আমিরাতে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচে।

দুবাইয়ে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে টসের সময় হাত মেলাননি দুই দলের অধিনায়ক। ম্যাচ যখন শেষ হয়, ক্রিজে ছিলেন সূর্যকুমার যাদব ও শিবম দুবে। খেলা শেষে তারা পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত না মিলিয়েই সাজঘরে যান। প্রতিবাদে পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন না পুরস্কার বিতরণের সময়। ম্যাচের ফল ছাপিয়ে খেলোয়াড়দের হ্যান্ডশেক বা হাত না মেলানোর ঘটনাই এখন বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে।

পুরস্কার বিতরণের সময় পেহেলগামে নিহতদের পরিবারের পাশে থাকার কথাও বলেছেন সূর্যকুমাররা। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব। জানান, পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত না মেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সবাই মিলে। ‘দেখুন, আমি মনে করি জীবনের কিছু বিষয় খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার চেয়েও বড়। আমাদের সরকার ও বিসিসিআই সবাই একসঙ্গে এই সিদ্ধান্ত (হাত না মেলানো) নিয়েছিলাম। আমরা এখানে ওদের বিপক্ষে শুধু খেলতে এসেছি এবং উচিত জবাব দিয়েছি।’

হ্যান্ডশেক না করার কারণেই যে পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা প্রেজেন্টেশনে অংশ নেননি তা নিশ্চিত করেছেন পরে পাকিস্তানের কোচ মাইক হেসন, ‘আমরা ম্যাচ শেষে হাত মেলাতে প্রস্তুত ছিলাম। আমাদের প্রতিপক্ষ সেটা করেনি, এতে আমরা হতাশ। আমরা হাত মেলাতে এগিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারা ততক্ষণে ড্রেসিংরুমে চলে গিয়েছিল। আমরা অবশ্যই হাত মেলাতে আগ্রহী ছিলাম।’

pakitstan_team

পাকিস্তানের সাবেক খেলোয়াড় রশিদ লতিফ ভারতীয় ক্রিকেট দলের ওপর ক্ষেপে গিয়ে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, তোমরা ভারত ক্রিকেট দল। হ্যাঁ, তোমরা বিশ্বের সেরা দল, কিন্তু খেলা শেষে হাত মেলাওনি। এতেই তোমাদের আসল রূপ প্রকাশ পায়! পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা অপেক্ষা করছিল, কিন্তু ভারতের খেলোয়াড়রা সোজা ড্রেসিংরুমে চলে গেল! আইসিসি কোথায়।’ রশিদ লতিফের মতো পাকিস্তানের অন্য সাবেক খেলোয়াড়রাও দোষ দেখছেন ভারতের। সাবেক পেস তরকা শোয়েব আখতার বলেছেন, ‘সূর্যকুমার যাদবের হ্যান্ডশেক না করার ঘটনা হতাশাজনক। এটা ক্রিকেট ম্যাচ, রাজনৈতিক ইস্যু নয়। খেলোয়াড় হিসেবে কিছু লড়াই হতে পারে, কিন্তু হাত না মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও বাড়ানো উচিত নয়। আমি নিজে হাত মেলাতাম।’

রাজনৈতিক বিরোধে আর্থিক লোকসানে দুই দেশ-

রাজনৈতিক এই উত্তেজনা এবং নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে এই দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিক হওয়ার পথে বাধাগ্রস্ত। আর এর জন্য আয়ের দিকে বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে আইসিসি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্টান। কেননা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে লাভজনক ইভেন্টগুলোর একটি। এই ম্যাচগুলো সম্প্রচার, স্পনসরশিপ এবং টিকিট বিক্রি থেকে বিপুল পরিমাণ আয় করে।
 
২০১৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের জন্য ৮ লাখেরও বেশি টিকিট ক্রয়ের আবেদন জমা পড়েছিল, এবং টেলিভিশন সম্প্রচারে এই ম্যাচ ২৭.৩ কোটি দর্শক আকর্ষণ করেছিল। এই বিশাল দর্শক সংখ্যা সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান এবং স্পনসরদের জন্য সোনার খনি। 

আইসিসির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২০২৭ চক্রে সম্প্রচার স্বত্ব থেকে ৩২০ কোটি ডলার এবং অন্যান্য খাত থেকে ১০০ কোটি ডলার আয়ের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই আয়ের একটি বড় অংশ আসে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ থেকে।

india_team

ফলে এই ম্যাচগুলোর আর্থিক গুরুত্ব এতটাই যে, আইসিসি নিশ্চিত করে যে প্রতিটি বড় টুর্নামেন্টে এই দুই দল মুখোমুখি হয়। তবে, দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ থাকায় এই আয়ের সম্ভাবনা কিছুটা সীমিত হয়েছে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ আয়োজনের জন্য বারবার চাপ দিলেও, ভারতের অনীহা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে, আইসিসি ইভেন্ট এবং নিরপেক্ষ ভেন্যু (যেমন দুবাই) এখন এই দুই দলের ম্যাচের প্রধান মঞ্চ।

ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব ভুলে ক্রিকেটে সুদিন ফিরবে কবে-

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটের সুদিন ফিরে আসার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় অস্তিত্বহীন, এবং সামরিক উত্তেজনা ক্রিকেটকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। তবে, অতীতে ক্রিকেট কূটনীতি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী এবং ২০০৫ সালে পারভেজ মুশাররফের ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে ভ্রমণ সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ছিল।

আইসিসির নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত (২০২৭ পর্যন্ত) কিছুটা হলেও ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য সুখবর। তবে, দ্বিপাক্ষিক সিরিজ পুনরায় শুরু হওয়ার জন্য দুই দেশের সরকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অগ্রগতি প্রয়োজন। এছাড়া, ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সমর্থকদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।