স্পোর্টস ডেস্ক
১৭ জুন ২০২৫, ০৫:৩০ পিএম
কাঁধে এক পাশে ফেরেশতা, অন্য পাশে শয়তান- এই পুরোনো প্রবাদটার মতোই নিজের ভেতরে চলছিল দুই কণ্ঠের লড়াই। এমনটাই জানিয়েছেন কাগিসো রাবাদা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালজুড়ে নিজের মাথার ভেতরের এই যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে রাবাদা জানালেন, শেষ পর্যন্ত তিনি পজিটিভ কণ্ঠটাই শুনেছেন।
লর্ডসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সব সময় মাথায় দুই রকমের আওয়াজ থাকে- একটা সন্দেহ করে, একটা বিশ্বাস করে। বড় মুহূর্তগুলোতে, যেমন এই ফাইনাল ম্যাচে, আমাদের সেই বিশ্বাসের কণ্ঠটাকেই বেশি শুনতে হয়। সেটাই আমরা করেছি বলেই এমন পারফরম্যান্স এসেছে। এটা আমাদের দলের এই মৌসুমের পরিশ্রমের প্রমাণ।” ১০ সেশন ধরে চলা উত্তেজনাপূর্ণ এই টেস্ট ম্যাচের শুরুতেই দারুণ ভাবে এগিয়ে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ২১২ রানে অলআউট করে দিয়ে ভালো জায়গায় ছিল তারা। কিন্তু নিজেদের ইনিংসে মাত্র ১৩৮ রানে গুটিয়ে গিয়ে যেন সব খুইয়ে বসে তারা।
তবে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে আটকে রাখাই ছিল ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার চাবিকাঠি। একসময় স্কোরবোর্ডে ৭৩ রানে ৭ উইকেট তুলে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে ফেরে। যদিও সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৮২ রান। তারপরও দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ শুকরি কনরাড মনে করছিলেন, উইকেট যেহেতু ব্যাটিংয়ের জন্য অনুকূল হয়ে আসছিল, লক্ষ্যটা নাগালেই আছে। “আমরা কোথায় ম্যাচটা ঘুরিয়ে দিলাম? অবশ্যই বোলিংয়ে। চাইলে আমরা ফিল্ডিংয়ে গা ছাড়া মনোভাব দেখাতে পারতাম, তাহলে ওরা বড় স্কোর করে ফেলত,” বলেন কনরাড। “আর কেজি, ও-ই সুপারস্টার। ও জানত, আমাদের হাতে একটা সুযোগ ছিল, আর সেটা ও কাজে লাগিয়েছে।”
তবে রাবাদা নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র গর্ব করেন না। “আমি নিজেকে তারকা হিসেবে দেখি না,” বললেন তিনি। তবে পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তিনি, আর ২০০ টির বেশি উইকেট পাওয়া বোলারদের মধ্যে তার স্ট্রাইক রেটই সেরা। তিনি বলেন, “আমি নিজেকে একজন লড়াকু ক্রিকেটার হিসেবে দেখি, যে দলকে ভালোবাসে, পরিশ্রম করে, নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করে। ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে যখন শরীর ক্লান্ত থাকে, সেখানেই আসল পরীক্ষা। আমরা তখন পিছিয়ে ছিলাম, কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে সামনে তাকাতে হয়েছে।”
রাবাদা এই দলকে দেখেন বন্ধুদের একটা গ্রুপ হিসেবে। এটাও খুব স্বাভাবিক, কারণ দলটির অধিকাংশই একে অপরের পরিচিত বহুদিনের। জোহানেসবার্গের একই স্কুল থেকে এসেছেন রাবাদা, উইয়ান মুল্ডার ও রায়ান রিকেলটন। কেপটাউনের আরেকটি স্কুল থেকে কাইল ভেরেইনা ও ডেভিড বেডিংহাম। রাবাদা ও তেম্বা বাভুমা একসঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন অনেক দিন ধরে। রাবাদা ও আইডেন মারক্রাম একসঙ্গে খেলেছেন ২০১৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে, যেখানে তারা ট্রফি জিতেছিলেন। লুঙ্গি এনগিডিও ছিলেন সেই দলের সদস্য হওয়ার কথা, কিন্তু ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি।
এনগিডিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করলেন রাবাদা। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম তিন উইকেট তুলে নিয়েছিলেন রাবাদা, আর মধ্যভাগে এনগিডি একাই ধস নামান। নয় ওভারে ৩ উইকেট এনে দেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ভালো করতে না পারলেও, দ্বিতীয় ইনিংসে দুর্দান্ত ঘুরে দাঁড়ান এনগিডি। কোচ কনরাড বলেন, “আমরা এনগিডিকে দলে রেখেছিলাম তার বাউন্স, সিম ও সুইংয়ের জন্য। আর সে তার কাজটা করে দিয়েছে।”
প্রথম ইনিংসে বাজে পারফরম্যান্সের পর এনগিডির উন্নতির জায়গা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রাবাদা হেসে বলেন, “ওকে বলেছিলাম একটা স্টেক খেতে, মিল্কশেক খেতে, সিনেমা দেখতে। ও তাই-ই করেছে। মিল্কশেক খেয়েছে, স্টেক খেয়েছে, সিনেমা দেখেছে- আর ফিরে এসে কামাল দেখিয়েছে!” রাবাদা স্পষ্ট করে দেন, পুরো দলটাই তার চোখে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এরা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে, শিখেছে, পরিণত হয়েছে, সবকিছুই ঘটেছে ক্যামেরার সামনেই, সবার চোখের সামনে। তাদের শিখতে হয়েছে মাঠেই, অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে। আর সেই কারণেই এই জয় আরও তাৎপর্যপূর্ণ।
দক্ষিণ আফ্রিকা টানা আটটি টেস্ট ম্যাচ জিতেছে, সামনে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আরও দুইটি ম্যাচ, যা হলে হবে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ জয়রথ। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তারা জিতেছে এমন একটি ট্রফি, যার নামের মধ্যেই ‘বিশ্ব’ শব্দটি আছে।
“আমি এই মুহূর্তটা কোনো দিন ভুলব না। আমাদের দলের কোনো খেলোয়াড় ভুলবে না। অস্ট্রেলিয়ার মতো অভিজ্ঞ দলের বিপক্ষে খেলে এই শিরোপা জেতা সত্যিই বিশেষ কিছু। তাদের কয়েকজন খেলোয়াড় যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছে, তখন আমরা স্কুলে পড়ি!”, আবেগে গলা ভারী হয়ে বললেন রাবাদা। তার মতো করেই আজ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমী এই জয়কে দেখছেন, একটা স্বপ্নপূরণের মতো।