ধর্ম ডেস্ক
১২ জুন ২০২৩, ০১:৪২ পিএম
হজ ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রত্যেক সুস্থ এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য একবার হজ করা ফরজ। অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি আছেন যাদের ভাগ্যে হজ নসিব হয় না। আবার এমন অনেক লোক আছেন যারা অসুস্থ বা তেমন কোনো সামর্থ্য নেই, আল্লাহর রহমতে তবুও তাদের হজ করার সৌভাগ্য হয়ে যায়। আল্লাহর মেহমান হওয়া নিঃসন্দেহে অনেক গর্বের বিষয় এবং হাজিরা আল্লাহর কাছে অনেক সম্মানিত।
হজের ব্যাপারে অনেক তথ্য না জানার কারণে এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় অনেক সময় বিদেশের মাটিতে বিপাকে পড়তে হয় হাজিদের এবং অনেক সময় হজ হয়ে ওঠে ভুলে ভরা। নতুন হাজিদের জন্য পরামর্শমূলক কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো, যা কাজে আসবে বলে আশা করছি। অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়গুলো তুলে ধরছি।
১. যারা বেসরকারিভাবে হজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা অবশ্যই যে এজেন্সির মাধ্যমে যাবেন, সেই এজেন্সির খোঁজ-খবর নেবেন। তারা ‘হাব’ এর সদস্য কিনা, তাদের অতীত রেকর্ড কেমন, মক্কা মদীনায় কোথায় রাখবে, বায়তুল্লাহ থেকে কত দূর রাখবে, এজেন্সির পক্ষ থেকে কত বেলা খাবার দেবে ইত্যাদি জেনে নিন।
২. জেনে নিন, আপনি যে গ্রুপের সঙ্গে হজে যাচ্ছেন সেই গ্রুপের মোয়াল্লেম ভালোমানের আলেম কি না, মোয়াল্লেমের আগে হজের অভিজ্ঞতা আছে কি না। অনেক সময় লক্ষ করা যায় অনেক এজেন্সি তাদের হাজিদের নিয়ে ছেড়ে দেন। হাজিরা জানেনও না কোথায় কী করতে হবে। অনেক মোয়াল্লেম আলেম না হওয়ার কারণে নিজে ভুল করেন এবং হাজিদেরও ভুল করিয়ে দেন।
৩. মনে রাখবেন হজে যাওয়ার নিয়ত করার পর থেকেই আপনি আল্লাহর মেহমান। তাই হজে যাওয়ার আগে খুব ভালোমতো হজের নিয়ম-কানুন শিখে নেবেন, প্রশিক্ষণ নেবেন এবং তখন থেকেই আপনি আল্লাহর রাস্তায় বের হচ্ছেন সে রকম মন মানসিকতা লালন করতে শুরু করবেন। মাসআলা মাসায়েলগুলো ভালোমতো জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন। হজের নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে বাজারে অনেক বই-পুস্তক পাওয়া যায় আপনি সেগুলো ভালোভাবে পড়তে পারেন।
৪. হজের গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে তা হলো— ইহরাম অবস্থায় কী কী কাজ করতে পারবেন না। কারণ ইহরাম পরার পর থেকেই আপনার সামনে কোনো না কোনো পরীক্ষা আসবে। যেমন, ইহরাম অবস্থায় কোনো পশু-পাখি এমনকি কোনো পোকা মাকড় মারতে পারবেন না বা কাউকে মারার জন্য দেখিয়ে দিতে পারবেন না। এমন সময় আপনার সামনে মশা চলে এলো, আপনি অভ্যাসবশত মশা মেরে ফেললেন। মনে রাখতে হবে, কীট-পতঙ্গ পর্যন্ত মারা যাবে না এ সময়।
৫. ইহরাম অবস্থায় অনেক স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করেন বা একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করেন। আবার অনেকে পরচর্চা করেন। এসব থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৬. ভালোভাবে জেনে নিন কোন কোন স্থানে দোয়া কবুল হয়। যেমন- কাবা ঘরের ভেতর, জমজমের কাছে, সাফা-মারওয়ায়, সাফা-মারওয়ার সবুজ বাতির মাঝখানে, মাকামে ইবরাহিমের কাছে, আরাফাতের ময়দানে, মুজদালিফায়, মিনায়, তিন জামারাহর পাশে, হাজরে আসওয়াদ বা কাবা শরিফের কালো পাথরে চুমু খেয়ে দোয়া করলে তা কবুল হয়।
৭. মক্কা-মদিনার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে জেনে নেবেন। ফলে আপনার এজেন্সি যখন আপনাকে সেখানে ঘুরাতে নিয়ে যাবে তখন মনে পবিত্র এক অনুভূতি কাজ করবে।
৮. হজে যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ইবাদত। তাই নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে গিয়ে বসে না থাকলে মসজিদের ভেতর জায়গা পাবেন না। বিশেষ করে জুমার নামাজ শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে গেলে মসজিদের ভেতর ভালো জায়গা পাবেন।
৯. অনেক মহিলা জামাতে নামাজ পড়তে পারন না। যাওয়ার আগে শিখে নেবেন। ছেলেদের দায়িত্ব তাদের মাহরামদের জামাতে নামাজ পড়তে শিখিয়ে দেওয়া। কারণ আমাদের দেশের নারীরা মসজিদে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত নন।
১০. বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে সার্বক্ষণিক আপনার পরিচয়পত্র, মোয়াল্লেম কার্ড, হোটেলের কার্ড, কব্জি বেল্ট সঙ্গে রাখবেন। মনে রাখবেন, আপনি হারিয়ে গেলে এগুলোর মাধ্যমে আপনাকে আপনার এজেন্সির কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
১১. প্রতি ওয়াক্তে জানাজার নামাজ হয়। অনেক মহিলাই জানাজার নামাজ পারেন না। শিখে নেবেন। পড়লে ভালো।
১২. হজের সময় আপনি সারা দুনিয়ার মানুষকে একসঙ্গে দেখতে পাবেন। যেটা আর কোথাও পাবেন না। দেখতে পারবেন নানান মানুষের নানান রকম মত আর নিয়ম কানুন। যদি কেউ কোনো ভুল করে তাহলে তাকে সাবধানে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝাতে চেষ্টা করুন। কাউকে সরাসরি শোধরানোর চেষ্টা করবেন না। অপর ব্যক্তি না বুঝলে চুপ থাকুন।
১৩. দোয়া কবুল হওয়ার স্থানে মন ভরে দোয়া করুন এবং আগে থেকে ঠিক করে রাখুন কী দোয়া করবেন। অনেক সময় আবেগের কারণে কী দোয়া করবেন তা মনে থাকে না। মন ভরে কাবা ঘর দেখে নেবেন। কারণ আপনার নসিবে দ্বিতীয়বার কাবা ঘর দেখা সম্ভব নাও হতে পারে।
১৪. বিমানে ওঠার আগে থেকেই আপনার হ্যান্ডব্যাগে পাতলা জায়নামাজ এবং স্প্রে করা যায় এমন পানির বোতল সবসময় সঙ্গে রাখবেন। যাতে অজু করার জায়গা না থাকলে স্প্রে করে হাতের তালুতে পানি নিয়ে অজুর ফরজগুলো আদায় করে অজু করে নিতে পারেন।
১৫. আপনাকে অনেকক্ষণ মসজিদে থাকতে হবে। তাই সঙ্গে খেজুর, বাদাম বা শুকনো খাবার রাখবেন। মনে রাখতে হবে, কোনোভাবেই আপনাকে অসুস্থ হওয়া চলবে না। এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আপনি অসুস্থ হয়ে যান। যেমন বেশি ওমরা করতে গিয়ে অনেকে এমন অসুস্থ হয়ে যান যে ফরজ কাজ করতে পারেন না।
১৬. আপনি হজের আগে সামান্য রিলাক্স মুডে থাকতে পারেন, এতে হজের সময় কষ্ট কম হবে। অতিরিক্ত জিয়ারাহ বা তাওয়াফ হজের পরে করাই ভালো। প্রচুর পরিমাণে পানি ও জুস খেতে হবে। হজের সময় কমদামী এবং হালকা স্যান্ডেল ব্যবহার করবেন।
১৭. যখন মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান করবেন, তখন চেষ্টা করবেন আপনার ব্যাগের ওজন যেন কম হয়। কারণ অনেক হাঁটতে হবে এবং সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হবে।
১৮. জামারাতে (পাথর নিক্ষেপের জায়গায়) বড় ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেবে না। ব্যাগ নিয়ে ফেলে দেয় অনেক সময়। তাই সাবধান। নিক্ষেপ করার পাথর পারলে মোয়াল্লেমের মাধ্যমে আগেই সংগ্রহে রাখবেন।
১৯. ইহরাম অবস্থায় আপনি কোনো সুগন্ধি বা সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না। অনেকেই বিভিন্ন লোশন ও সাবান ব্যবহার করেন যা সুগন্ধিযুক্ত। এটি নাজায়েজ। এক্ষেত্রে সুগন্ধি ছাড়া লোশন ও ভেসলিন ব্যবহার করতে পারেন।
২০. ইহরাম অবস্থায় অনেকেই বাথরুম ব্যবহার করার পর সাবান দিয়ে হাত ধোয় না, যা স্বাস্থ্যসম্মত না। মিনা, মুজদালিফা ও আরফায় বাথরুমে যাওয়ার সময় আগে থেকেই ছোট করে টুকরো করা সুগন্ধি ছাড়া সাবান ও প্লাস্টিক বা পলিথিন নেবেন। বাথরুমে যে পানির পাইপ থাকে তা প্রায়সময় মাটিতে পড়তে থাকে। পলিথিন দিয়ে পাইপ ধরতে পারেন বা হ্যান্ড গ্লাভস দিয়ে। তবে হ্যান্ড গ্লাভস পরা ও খোলা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই পলিথিনই ভালো। বাথরুমের বাইরে অনেক লোক অপেক্ষা করে থাকে। তাই চেষ্টা করবেন দ্রুত কাজ শেষ করে আসতে।
২১. আরাফার ময়দানে অনেক নিম গাছ দেখতে পাবেন। ইহরাম অবস্থায় আপনি কোনো গাছের ডাল ভাঙতে পারবেন না। কিন্তু অনেকেই গাছের ডাল ভেঙে মেসওয়াক করে। এ ব্যাপারে সাবধান। প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখবেন। বিশেষ করে মুভ, প্যারাসিটামল, অ্যাসিডিটির ওষুধ, স্যালাইন ইত্যাদি। তাছাড়া নিয়মিত কেউ যদি কোনো ওষুধ খায় সেগুলো কতদিনের প্যাকেজের জন্য যাচ্ছেন সেই হিসেবে সঙ্গে রাখবেন।
২২. মদিনায় যখন মসজিদে কুবায় যাবেন, তখন হোটেল থেকে অজু করে যাবেন। কারণ বাসা থেকে অজু করে মসজিদে কুবায় দুরাকাত নফল নামাজ পড়লে একটা ওমরা হজের সওয়াব পাওয়া যায়।
২৩. জামারাতে যখন পাথর মারা হয় তখন অনেকেই জুতা, স্যান্ডেল, বোতল ছুড়ে মারেন। এটা করা যাবে না। গালাগালিও করা যাবে না। পাথর মারার সময় দোয়া পড়ে পাথর মারতে হবে এবং মনের ভেতর এমন একটা ফিলিংস আনতে হবে যে, ‘আমি সুন্নত অনুযায়ী ইবাদত করছি মাত্র।’ এখানেই ইবরাহিম (আ.) শয়তানকে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন।
২৪. মদীনায় মহানবী (স).-এর রওজা শরিফে মেয়েদের সবসময় ঢুকতে দেওয়া হয় না। ফজর, জোহর ও এশার নামাজের পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঢুকতে দেয়। মেয়েদের জন্য ২৫ নং গেট দিয়ে ঢুকলে সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশসহ সব দেশের মেয়েদের আলাদা আলাদা করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দৌড়াদৌড়ি এবং ধাক্কা-ধাক্কি করবেন না। তবে ছেলেদের এমন নিয়ম নেই। রিয়াজুল জান্নাহ দোয়া কবুলের জায়গা। শুধু সবুজ কার্পেট বিছানো অংশটুকু রিয়াজুল জান্নাহ।
২৫. আপনার লাগেজের গায়ে বাংলাদেশের পতাকার ছাপ লাগাতে হবে এবং লাগেজের গায়ে বাংলা, ইংরেজি ও আরবিতে বাংলাদেশ লিখতে হবে। তাছাড়া নিজের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, মোয়াল্লেম নম্বর লিখতে হবে। দড়ি, টেপ, মার্কার পেন, কাঁচি, সুঁই-সুতা সঙ্গে রাখবেন।
২৭. আপনি মক্কা বা মদিনা যেখনেই থাকুন না কেন, সেখানে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখবেন। কোনো কারণে আপনার সঙ্গী বা আপনি হারিয়ে গেলে সেই জায়গায় চলে আসবেন। সঙ্গীদের ফোন নম্বর সঙ্গে রাখবেন। আপনি নিজে হারিয়ে গেলে সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশ হজ ক্যাম্পে জানান। তারাই আপনাকে আপনার হোটেলে পৌঁছে দেবে।
২৮. ফরজ তাওয়াফের সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়। সাফা-মারওয়ায় ফরজ তাওয়াফ দোতালায় করলে ভিড় একটু কম পাওয়া যায়। কারণ সবাই চায় নিচে তাওয়াফ করতে। ফরজ তাওয়াফের পর সাঈ করার সময় অনেক ভিড় হবে। তবে চার তলায় একটা সাঈ করার জায়গা আছে। সেখানে ভিড় কম হয়। জায়গাটা আগে থেকে দেখে রাখবেন। কারণ জায়গাটার সিঁড়ি পেতে কষ্ট হয়।
২৯. যেখানেই যাবেন চেষ্টা করবেন ২/৩ জন একসঙ্গে থাকতে, তাতে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আর হ্যাঁ, টাকা-পয়সা অবশ্যই সাবধানে রাখবেন। হজের প্রতিটি কাজ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করবেন যাতে সামান্য ভুলটুকুও না হয়। কোথাও কোনো ভুল হলে অবশ্যই দম (রক্ত বা কোরবানির মাধ্যমে কাফফারা) দিতে হবে। চেষ্টা করবেন মানুষের সৃষ্ট জটলা এড়িয়ে চলতে। মনে রাখবেন এখানে আসার পেছনে উদ্দেশ্য শুধু একটাই আর সেটা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে গুনাহ মাফ করানো।
আল্লাহ তাআলা সকল হজযাত্রীকে যাবতীয় ভুল-ভ্রান্তি থেকে দূরে রাখুন। সতর্ককতার সঙ্গে সুন্নাহ অনুযায়ী হজের সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
নতুন হজযাত্রী, প্রথম হজে গেলে জেনে রাখুন, হজযাত্রায় জেনে রাখা প্রয়োজন, প্রথমবার হজ বিভিন্ন অসুবিধা, নতুন হজযাত্রীদের জন্য পরামর্শ