images

ইসলাম

ইসলামে মেহমানদারির বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত

ধর্ম ডেস্ক

৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:০২ পিএম

মেহমানদারি একটি মহৎ গুণ, যা আত্মীয়তার বন্ধনকে মজবুত করে, বন্ধুত্বকে সুদৃঢ় এবং সামাজিক সৌহার্দ্য সৃষ্টিতে রাখে বড় ভূমিকা। কোনো ব্যক্তি যখন কারও বাড়িতে উপস্থিত হন, তখন তিনি সেই বাড়ির মেহমান। আর যার বাড়িতে মেহমান গেছেন, ইসলামি পরিভাষায় তিনি মেজবান।

সকল নবী ও রাসুল অতিথিপরায়ণ ছিলেন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আতিথেয়তায় ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। তিনি দিনে অন্তত এক বেলা মেহমান ছাড়া আহার করতেন না। হজরত ইবরাহিম (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন—

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে প্রেরিত ফেরেশতাদের দলে হজরত জিবরাইল (আ.), মিকাইল (আ.) ও ইসরাফিল (আ.) ছিলেন। তাঁরা মানুষের আকৃতি ধরে ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আগমন করেন। তিনি তাঁদের মানুষ মনে করে আতিথেয়তার আয়োজন করেন। ইবরাহিম (আ.)-ই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মেহমানদারির প্রথা প্রচলন করেন। (তাফসিরে কুরতুবি)

ইসলামে মেহমানদারির মর্যাদা অনেক বেশি। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মেহমানদারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক সময় অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে অনাহারে থাকতে হয়েছে। নিজ ঘরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে তিনি মেহমানদের কোনো ধনী সাহাবির বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। নবী হওয়ার আগে থেকেই তিনি অতিথিসেবায় সচেষ্ট ছিলেন।

সর্বপ্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়ে যখন তিনি অনেকটা বিচলিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তখন হজরত খাদিজা (রা.) তখন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এভাবে— 

“আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল। আর রমজান মাসে তিনি সবচেয়ে বেশি দান করতেন। যখন জিব্রাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি প্রবল বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হতেন।” (বুখারি: ৬; মুসলিম: ২৩০৮)

আতিথেয়তা শুধু নৈতিক ও মহৎ কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক সময় তা আবশ্যক হয়ে উঠে বলে মনে করেন কোনো কোনো আলেম। তাদের মতে, বহিরাগত মেহমানের মেহমানদারি করা গ্রামবাসীর জন্য ওয়াজিব বা অত্যাবশ্যকীয়। কেননা গ্রামে সাধারণত হোটেলের ব্যবস্থা নেই। তবে শহরে যেহেতু হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে, তাই সে ক্ষেত্রে মেহমানদারি সুন্নত। (তাফসিরে কুরতুবি)

মেজবানের আদব করণীয়

এক. মেহমান এলে খুব দ্রুত তাঁকে স্বাগত জানাবে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিরা মহানবী (সা.)-এর কাছে আগমন করেন, মহানবী (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কারা? তারা বলল, আমরা (আবদুল কায়েস গোত্রের) রবিআ শাখার লোক। মহানবী (সা.) বললেন, ওই জাতিকে মারহাবা! ওই প্রতিনিধিদলকে মারহাবা! এটা তোমাদের অপরিচিত কোনো জায়গা নয়। এখানে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। (বুখারি: ৫৩; মুসলিম: ১৭)

দুই. উপস্থিত যা আছে, তা দিয়ে আপ্যায়ন করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওবায়েদ ইবনে উমায়ের (রহ.) বলেন, হজরত জাবের (রা.) নবী করিম (সা.)-এর সাহাবিদের এক জামাতের সঙ্গে আমার কাছে তাশরিফ আনলেন। হজরত জাবের (রা.) সঙ্গীদের সামনে রুটি ও সিরকা পেশ করলেন এবং বললেন, এটা খাও, কেননা আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ইরশাদ করতে শুনেছি, “সিরকা উত্তম তরকারি। সে ধ্বংস হোক, যে তার কয়েকজন ভাই তার কাছে আসে, আর সে ঘরে যা আছে, তা তাদের সামনে পেশ করাকে কম মনে করে। ওই সব লোক ধ্বংস হোক, যারা তাদের সামনে যা পেশ করা হয়, তারা তাকে তুচ্ছ ও কম মনে করে।” অন্য এক বর্ণনায় আছে, মানুষের ধ্বংসের জন্য এটা যথেষ্ট যে, যা তার সামনে পেশ করা হয়, সে তাকে কম মনে করে। (মুসনাদে আহমাদ, তাবারানি)

তিন. মেহমানের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা। মেহমান কারো কাছে গিয়ে মেজবানের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসবে না। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, কেউ কারো ঘরে গিয়ে তার অনুমতি ছাড়া তার নির্দিষ্ট আসনে বসবে না। (মুসলিম: ২৮৩)

চার. মেহমান আলেম হলে তাকে অত্যধিক সম্মান করা। আল্লাহ বলেন, যাদের ধর্মীয় জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নীত করবেন। (সূরা মুজাদালা: ১১)

পাঁচ. মেজবান ও বাড়ির কর্তা নিজেই মেহমানদারির কাজে অংশগ্রহণ করা। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, তিনি নিজেই দ্রুত আগত মেহমানদের জন্য মেহমানদারির ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, তোমার কাছে ইবরাহিমের সম্মানিত মেহমানদের কথা পৌঁছেছে কি? যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম। ’ জবাবে সেও বলল, ‘সালাম। ’ তারা তো (ছিল) অপরিচিত লোক। তারপর ইবরাহিম তার স্ত্রীর কাছে গেল এবং মোটাতাজা গরুর বাছুর ভুনা করে নিয়ে এলো। তারপর তা তাদের সামনে রেখে বলল, ‘তোমরা খাচ্ছ না কেন?’ (সুরা জারিয়াত: ২৪-২৭)

ছয়. খাবার নিয়ে কোনো লৌকিকতা প্রদর্শন করবে না। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে ছিলাম। তিনি বললেন, আমাদেরকে লৌকিকতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছে। (বুখারি: ৭২৯৩)

অন্য হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, দুজনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট। আর তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। (বুখারি: ৫৩৯২, মুসলিম: ২০৫৮)

hospitality

মেহমানের আদব করণীয়

এক. মেহমানের উচিত— চক্ষু সংযত রাখা ও দৃষ্টি অবদমিত রাখা। আল্লাহ বলেন, মুমিনদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। (সুরা নুর: ৩০)

দুই. মেহমান তাঁর আওয়াজ ও কণ্ঠস্বর নিচু রাখবেন। অহেতুক চেঁচামেচি করবেন না। হজরত লোকমান (আ.)-এর কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, তুমি তোমার কণ্ঠস্বর নিচু রেখো। নিশ্চয়ই কণ্ঠস্বরের মধ্যে গাধার কণ্ঠস্বরই সবচেয়ে অপ্রীতিকর। (সুরা লোকমান: ১৯)

তিন. খাবার শেষ হলে মেহমান এই দোয়া পাঠ করবেন— আল্লাহুম্মা বারিক লাহুম ফিমা রাজাকতাহুম। ওগফির লাহুম ওর্হামহুম। (মুসলিম: ২০৪২) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি তাদের রিজিকে বরকত দান করুন, তাদের ক্ষমা করুন এবং তাঁদের ওপর অনুগ্রহ করুন।”

চার. খাবার শেষ হলে মেহমানের কোনো কাজ না থাকলে চলে যাবেন। অহেতুক বসে থেকে মেজবানের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন না। মহানবী (সা.)-এর এক ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, খাওয়াদাওয়া শেষে তোমরা চলে যাও। তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। কারণ তোমাদের এই আচরণ নবীকে পীড়া দেয়। সে তোমাদের উঠিয়ে দিতে সংকোচ বোধ করে। (সুরা আহজাব: ৫৩)

পাঁচ. মেহমানের উচিত হলো দীর্ঘ সময় বা দীর্ঘদিন অবস্থান করে মেজবানকে বিরক্ত না করা। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। মেহমানের পারিতোষিক (বিশেষ মেহমানদারি) এক দিন ও এক রাত। (স্বাভাবিক) মেহমানদারি তিন দিন। এর অতিরিক্ত মেহমানদারি সদকাস্বরূপ। মেহমানের জন্য বৈধ নয় যে, সে মেহমান হতে হতে মেজবানকে বিরক্ত করে ফেলবে। (বুখারি: ৬১৩৫; মুসলিম: ৪৮)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক মেহমান ও মেজবানকে নিজ নিজ হক যথাযথ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএ/