জহির উদ্দিন বাবর
০২ এপ্রিল ২০২২, ১০:৩৯ পিএম
বছর ঘুরে আবার মুমিনের দুয়ারে হাজির পবিত্র মাহে রমজান। প্রতি বছর কল্যাণ ও মঙ্গলের অপার সম্ভাবনা নিয়ে আসে এই মাস। ছড়িয়ে দেয় রহমত, মাগফেরাত ও মুক্তির অমিয় বার্তা। এই মাসে করুণাময় প্রভু তাঁর অফুরন্ত রহমত ও শান্তির বারিধারা বর্ষণ করেন। তাঁর নেয়ামতের ভাণ্ডার খুলে দেন। অগণিত বান্দাকে মাফ করে দেন। মুক্তির সুসংবাদ পৌঁছে দেন মুমিনের দুয়ারে দুয়ারে।
গত দুটি বছর মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে লকডাউনের মধ্যে আমাদের পালন করতে হয়েছে রোজা। এজন্য সবাইকে নিয়ে ইফতার-তারাবিসহ অনেক আনুষ্ঠানিকতা করতে পারিনি। তবে আল্লাহর অনুগ্রহে এবার করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকায় তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। এজন্য এবার চিরাচরিত আমেজে রমজান উদযাপন করতে পারবো। এজন্য সবার উচিত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে শোকর আদায় করা। এ ধরনের মহামারি পরিস্থিতির দুঃসহ স্মৃতি যেন আর ফিরে না আসে সেই দোয়া করা। পাশাপাশি সতর্কতা অবলম্বনেরও কোনো বিকল্প নেই। কারণ করোনা পরিস্থিতি স্থিমিত থাকলেও যেকোনো সময় এর অবনতি ঘটতে পারে। এজন্য স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে উদাসীন হওয়া যাবে না।
রোজা বা সিয়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক চাহিদার মধ্যে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন করে। এর মাধ্যমে পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে যায় এবং মনুষত্যবোধ জাগ্রত হয়।
রমজান মুমিনজীবনের অনন্য প্রাপ্তি। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের বহুমুখী কল্যাণের সন্ধান দেন। মানুষের গতিপথ বিভ্রান্ত করার জন্য অভিশপ্ত শয়তান সবসময় পাঁয়তারা করতে থাকে। কিন্তু রমজানের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শয়তানকে বন্দী করে দেওয়া হয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। রমজানে মানবতার প্রত্যাশিত ঠিকানা জান্নাতের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়। আর অভিশপ্ত জাহান্নামের দুয়ার দেওয়া হয় বন্ধ করে। যারা জীবনের স্রোতধারা সঠিক পথে প্রবাহিত করতে চান তাদের জন্য রমজান আশির্বাদস্বরূপ।
পবিত্র রমজানের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে বরকত লুকিয়ে আছে। এই মাসের নফল কাজগুলো ফরজ কাজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজগুলো সত্তর গুণ অধিক মর্যাদা পায় (বায়হাকি)। রমজান মাস এলে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, সৎ পথে চলার পথ সহজ হয়ে যায়, শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয় (বুখারি ও মুসলিম)। অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে রোজা ঢালস্বরূপ। যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে তার অতীত ও বর্তমানের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতে পরিপূর্ণ। এ সম্পর্কে রাসুল সা. বলেন, ‘আর এটি এমন একটি মাস, যার প্রথম ভাগে আল্লাহর রহমত, মধ্যভাগে গোনাহের মাগফেরাত এবং শেষ ভাগে দোজখের আগুন থেকে মুক্তিলাভ রয়েছে।’ (মিশকাত) এসব সুসংবাদ কেবল তাদের জন্যই, যারা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রমজানের পূর্ণ একটি মাস রোজা পালন করেন, নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখেন। রোজাদার ব্যক্তিরাই দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম।
মহাবরকত ও কল্যাণের মাস মাহে রমজানে বেশি বেশি দোয়া-দরুদ পাঠ, তওবা-ইস্তেগফার ও প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর রহমতের ভাগিদার হওয়া যায়। রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতে পরিপূর্ণ। রোজা পালনের মধ্য দিয়ে মুমিন বান্দারা আত্মিকভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাই আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের জন্য পবিত্র রমজান মাসে তার রহমতের দরজা অবারিত করে দেন। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা. ইরশাদ করেন, রমজান মাসে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্ববর্তী কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। ১. রমজানের প্রথম রাতে আল্লাহ তাদের দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন, আর আল্লাহ যার দিকে দৃষ্টি দেন, তাকে কখনও শাস্তি দেন না। ২. সন্ধ্যার সময় তাদের মুখ থেকে যে গন্ধ বের হয় তা আল্লাহর কাছে মেশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। ৩. রমজানের প্রতিটি দিনে ও রাতে ফেরেশতারা রোজাদারদের জন্য দোয়া করেন। ৪. আল্লাহ তার বেহেশতকে বলেন, তুমি আমার বান্দার জন্য সুসজ্জিত ও প্রস্তুত হও! আমার বান্দারা অচিরেই দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট থেকে অব্যাহতি পেয়ে আমার বাড়িতে ও আমার সম্মানজনক আশ্রয়ে এসে বিশ্রাম নেবে। ৫. রমজানের শেষ রাতে আল্লাহ তাদের সব গোনাহ মাফ করে দেন। এক ব্যক্তি বললেন, এটা কি লাইলাতুল কদর? রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘না, তুমি দেখনি শ্রমিকেরা যখন কাজ শেষ করে তখনই পারিশ্রমিক পায়?’ (বায়হাকি)
আমরা প্রত্যেকেই আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের আল্লাহর রহমতের প্রয়োজন পড়ে। আল্লাহর রহমত কারো অনুকূলে না থাকলে জীবনে ধ্বংস অনিবার্য। যারা দুনিয়াতে সফল হয়েছেন সবাই আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতপ্রাপ্ত। রমজান আমাদেরকে আল্লাহর রহমত লাভের অনন্য সুযোগ করে দিয়েছে। এই মাসে আমরা বেশি বেশি করে তওবা, ইস্তেগফার ও দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। আমরা আল্লাহর দিকে যত দ্রুত এগিয়ে যাবো আল্লাহ এর চেয়ে শতগুণ বেশি বেগে আমাদের দিকে ছুটে আসবেন। আল্লাহর রহমতও এমনই। যারা গোলামির মাধ্যমে আল্লাহকে রাজি-খুশি করতে পারবে দুনিয়া-আখেরাতে আল্লাহর রহমত তাদের সঙ্গী হবে।
রমজানে রয়েছে মুমিনের জন্য কাঙ্ক্ষিত সফলতা লাভের জোরালো হাতছানি। যারা পাপাচারের মাধ্যমে জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন রমজান তাদের ক্ষান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। পাপের খনিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বান্দাকেও এই মাসের বরকতে মাফ করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন মহান রাব্বুল আলামিন। রমজানের প্রাপ্তি ও সুফল নিশ্চিত হওয়ার পূর্বশর্ত হলো, এই মাসের দাবি যথাযথভাবে আদায় করা। রমজানে পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা অতি সহজ। কারণ মানুষের চিরশত্রু ইবলিশকে তখন শিকলবদ্ধ করে রাখা হয়। সে জন্য রমজানের বাঁকা চাঁদ পাপমুক্ত থাকার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। আমাদের একটু সদিচ্ছাই পারে পাপমুক্ত জীবনের সূচনা করতে। তাই আসুন রমজানের শুরু থেকেই আমরা পাপমুক্ত জীবন গড়ার অঙ্গীকার করি।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, ঢাকা মেইল