ধর্ম ডেস্ক
১০ মে ২০২৩, ০১:১৫ পিএম
ফলমুল আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত। এই নেয়ামত খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি শরীরের শক্তিবর্ধক। একইসঙ্গে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। দেশি মৌসুমী ফলগুলো স্বাভাবিকভাবেই পাকে, জোর করে পাকাতে হয় না। প্রয়োজন পড়ে না দীর্ঘদিন সংরক্ষণেরও। তাই এতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার না করলেও চলে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৌসুমি ফল ও বিভিন্ন খাদ্যে কেমিক্যাল প্রয়োগ বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। ফলমুল, শাকসবজি, মাছ-মাংস কিছুই মুক্ত থাকছে না ভেজালের সংমিশ্রণ থেকে। কেমিক্যাল মেশানোর কারণে ফলের পুষ্টি ও স্বাদ কোনোটাই থাকে না। মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা তো রয়েছেই। যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে মুসলমান নয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন নবীজি (স.)। ইসলাম অনুযায়ী তারা প্রতারক ও হারাম উপার্জনকারী হিসেবে সাব্যস্ত এবং তাদের কোনো ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদিন রাসুলুল্লাহ (স.) বাজারে খাদ্যস্তূপের ভেতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন, ভেতরেরগুলো ভেজা। তিনি বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, খাদ্যে এমনটা করা হলো কেন? বিক্রেতা বলল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, হে আল্লাহর রাসুল! নবী কারিম (স.) বললেন, তাহলে তুমি খাদ্যগুলো ওপরে রাখনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত? লোকটি চুপ করে রইল। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।’ (সহিহ মুসলিম: ১০২)
হাদিসটি লক্ষ্য করুন। ভেজা-শুকনা গোপন করার মতো প্রতারণাই ইসলামে নিষিদ্ধ। সেখানে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার কতটা মারাত্মক অপরাধ হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। আম, কাঁঠাল ইত্যাদি পাকানোর জন্য যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
চিকিৎসকদের মতে, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, অ্যাসিটিলিন গ্যাস, কার্বন-মনোক্সাইডের মতো রাসায়নিকগুলি ব্যবহার করে কাঁচা আম, কাঠাল ও অন্যান্য কাঁচা ফল পাকানো হয়। রাসায়নিকগুলি এতটাই ক্ষতিকারক যে, ফলের মাধ্যমে তা শরীরে গেলে ত্বকের ক্যানসার, কোলন ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, লিভার ও কিডনির সমস্যা, মস্তিষ্কের ক্ষতির মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি রয়েছে।
আর এসব রোগ যদি কারো কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খাওয়ার কারণে হয় এবং এতে কেউ মারা যায়, সেই দায় ওই প্রতারক ব্যবসায়ীর। ইসলামে এই হত্যাকাণ্ডের পরকালীন শাস্তি জাহান্নাম। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম। যাতে সে দীর্ঘকাল থাকবে, তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও অভিসম্পাত। আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা: ৯৩)
ওই প্রতারকের ইহকালীন শাস্তিও কঠোর। ইসলাম অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারীকে সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করার নির্দেশ দেয়। প্রচলিত আইনেও খাবারে ভেজাল ও ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মেশানোর শাস্তি কঠিন। এটি সমাজবহির্ভূত, অনৈতিক ও অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচিত। কারণ এতে কয়েক ধরনের অপরাধ জড়িত। ১. প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি; ২. ভেজাল মেশানো অপরাধ ৩. অবৈধ পন্থায় অপরের অর্থ আত্মসাৎ ৪. মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া এমনকি ৫) বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগে হত্যা।
যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায় এবং কেমিক্যালের মিশ্রণে খাদ্যের গুণাগুণ নষ্ট করে তারা নামে মুসলমান হলেও তাদের কোনো ইবাদত কবুল হবে না। কারণ তাদের উপার্জিত অর্থ হারাম। আর রুজি-রুটি হালাল হওয়া ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। হাদিসে বলা হয়েছে, হারাম খাদ্যের মাধ্যমে যে রক্ত-মাংস তৈরি হবে, ওই রক্ত-মাংসের শরীরের মাধ্যমে কৃত কোনো ইবাদত কবুল করা হবে না। যেসব ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল দেয়, ভেজাল মেশায়, ভেজালে সমর্থন দেয়, ভেজাল থেকে উপকৃত হয় তাদের সম্পর্কে নবী কারিম (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদের মহাপাপীরূপে ওঠানো হবে, তবে যারা সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেছে তারা ছাড়া।’ (তিরমিজি: ১২১০)
বস্তুত ইসলাম একজন ব্যবসায়ীকে সৎ, নিষ্ঠাবান ও ওয়াদা পালনকারী হওয়ার উপদেশ দেয়। তিনি প্রতারণা, প্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে উঠে সত্ভাবে আয়-রোজগার করবেন এবং ব্যবসা পরিচালনার সব অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত থাকবেন। অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
ইসলামে ব্যবসাকে হালাল করার পাশাপাশি এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সততার নীতি অবলম্বন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হয়ে যাও।’ (সুরা তাওবা: ১১৯)
খাদ্যে ভেজাল কেমিক্যালের ব্যবহার রোধে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যেমন ঘন ঘন অভিযান চালিয়ে আর্থিক দণ্ডের পাশাপাশি শারীরিক কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে মানুষের ক্ষতি করে অধিক মুনাফা লাভের হীন মানসিকতা পরিহার করা, মানুষের মাঝে নৈতিকতাবোধ এবং পরকালীন জবাবদিহিতার বোধ জাগ্রত করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হালালভাবে অর্থ উপার্জনের তাওফিক দান করুন। খাদ্যদ্রব্যে ভয়াবহ কেমিক্যাল মেশানো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।