images

ইসলাম

আল্লাহ কেন আমাদের পরীক্ষা করেন?

ধর্ম ডেস্ক

২৫ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:২৫ পিএম

মহান আল্লাহ বান্দাকে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা করেন। বান্দাকে পরিশুদ্ধ করতে, ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে, গুনাহ মাফ করতে কিংবা উত্তম আমলকারীদের বাছাই করতে তিনি পরীক্ষা করে থাকেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবনকে পরীক্ষা করার জন্য যে তোমাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম, তিনি সর্বশক্তিমান, ক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক: ০২)

অনেকে মনে করেন, আল্লাহ তাআলা শুধু কষ্ট, মসিবত ও অসুস্থতা দিয়েই বান্দাকে পরীক্ষা করেন। এটি সত্য নয়। বরং সুখ-শান্তি দিয়েও আল্লাহ তাআলা বান্দাকে পরীক্ষা করেন। উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি চাকরি হারাই, তার মানে এই নয় যে আল্লাহ আমার উপর রাগান্বিত। অন্যদিকে, আমি যদি আমার চাকরিতে বেতন বৃদ্ধি পাই, তার মানে এই নয় যে আল্লাহ আমার প্রতি খুশি।

বস্তুত আমরা আল্লাহ তাআলার প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাই তা দেখার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে এই বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দিয়ে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আম্বিয়া: ৩৫)

উল্লেখিত আয়াতগুলো এই কথা প্রমাণ করছে যে পরীক্ষা জীবনেরই একটি অংশ। প্রত্যেককেই মাঝেমাঝে পরীক্ষা করা হবে যাতে আল্লাহ দেখতে পান কোন বান্দা তাঁর প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস ও ভরসা রাখেন। অন্য কথায়, তিনি দেখবেন কে সবসময় সৎকাজ করে এবং কে সুবিধাজনক হলেই ভালো কাজ করে। আবার পরীক্ষা যখন একটু কষ্টকর হয়, তখন বিনিময়স্বরূপ বান্দার গুনাহ মাফ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুসলমানের ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয়, এমনকি তার দেহে যে কাঁটা ফোটে, এসবের বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (বুখারি: ৫৬৪১; মুসলিম: ২৫৭৩)

অন্য হাদিসে এসেছে, জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘কেয়ামতের দিন বিপদে পতিত ব্যক্তিদের যখন প্রতিদান দেওয়া হবে, তখন (পৃথিবীর) বিপদমুক্ত মানুষেরা আফসোস করে বলবে, হায়! দুনিয়াতে যদি কাঁচি দ্বারা তাদের শরীরের চামড়া কেটে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হতো!’ (তিরমিজি: ২৪০২)

হাদিসগুলো আমাদের দেখায় যে বড়দাগে দুটি কারণে কাউকে পরীক্ষা করা হতে পারে। প্রথম কারণটি হলো— আল্লাহ আপনাকে এমন কিছু দিয়ে পরীক্ষা করবেন যাতে আপনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে এবং এর মাধ্যমে আপনার স্থান জান্নাতে উন্নীত করা হবে। দ্বিতীয় কারণ হলো— আপনি হয়ত কিছু গুনাহ করেছেন কিন্তু আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাননি। এর শাস্তি আখেরাতে দেওয়া হলে অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তাই পরীক্ষার মাধ্যমে তা দুনিয়াতেই সহজভাবে দিয়ে দেওয়া হয়। যাতে পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই মেলে। এই পরীক্ষাটি আসলে আল্লাহর রহমতের একটি রূপ।

পরীক্ষার সম্মুখীন হলে মনোভাব কেমন হওয়া উচিত?
পরীক্ষার সম্মুখীন হলেই মুসলমান হিসেবে আমাদের যে বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সেটি হলো— আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহ কাউকে সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেন না।’ (সুরা বাকারা: ২৮৬) অর্থাৎ কোনো বান্দাই এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি জীবনেও হবে না, যা বহন করার শক্তি তার থাকবে না। সুতরাং আমাদের কখনোই নিরাশ হওয়া উচিত হবে না বা ধৈর্য হারানো উচিত নয়। কারণ আমরা ইতোমধ্যেই জানি যে আমরা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাব এবং পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে।

আল্লাহ সর্বদা বান্দার জন্য ভালোটাই করেন
পরীক্ষা একটু কষ্টদায়ক হলে আল্লাহর এই কথাটি মনে রাখতে হবে যে, পবিত্র কোরআনে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘..হতে পারে, তুমি একটি জিনিস অপছন্দ করো যা তোমার জন্য ভালো এবং তুমি একটি জিনিস পছন্দ করো যা তোমার জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন কিন্তু তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা: ২১৬)

আল্লাহ অকারণে পরীক্ষা করেন না
একটি বিষয় আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ আমাদেরকে কখনোই বিনা কারণে পরীক্ষায় ফেলবেন না। বেশ কিছু সহিহ হাদিস রয়েছে যেখানে নবী (স.) উল্লেখ করেছেন যে আল্লাহ আমাদের নিজেদের মায়েদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। যেমন এক হাদিসে এসেছে, ‘মা তার সন্তানের উপর যতটুকু দয়ালু, আল্লাহ তাঁর বান্দার উপর তদাপেক্ষা অধিক দয়ালু।’ (সহিহ বুখারি: ৭/৭৫, কিতাবুল আদাব, হাদিস: ৫৯৯৯; সহিহ মুসলিম, ৪/২১০৯, কিতাবুত তাওবা, হাদিস: ২৭৫৪)

একজন মা কখনোই স্বেচ্ছায় তাদের সন্তানকে কোনো কারণ ছাড়াই কষ্টের মধ্যে ফেলেন না। অতএব, আল্লাহর প্রতিটি পরীক্ষার পেছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে, যদিও আমরা অনেকসময় তা বুঝতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, ছোটকালে মা-বাবা আমাদের অনেক কিছুই খেতে দিতেন না অসুস্থতার ভয়ে অথবা বড় কোনো ক্ষতির আশংকায় অনেক কিছুতে বারণ করতেন। মনে হতো উনারা অবিচার করছেন। পরে বড় হওয়ার পরে বুঝতে পারি- মা-বাবার ওসব নিষেধাজ্ঞার পেছনে উপযুক্ত কারণ ছিল। ঠিক একইভাবে আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি পরীক্ষার উদ্দেশ্য বান্দার জন্য কল্যাণজনক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পত্তি, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)

পরীক্ষার সময় কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্যে কল্যাণ 
সবসময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্যের গুরুত্ব মনে রাখতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মুমিনের বিষয়টি কতইনা চমৎকার! তার জন্য কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নেই। তার জন্য যদি কোনো খুশির ব্যাপার হয় এবং সে কৃতজ্ঞতা আদায় করে তাহলে সেটি তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কোনো দুঃখের বিষয় হয় এবং সে ধৈর্য ধারণ করে, সেটিও তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহিহ মুসলিম: ২৯৯৯)

এটি এমন একটি হাদিস যা আমাদের সর্বদা মনে রাখা উচিত। সবসময় মনোভাব রাখতে হবে ইতিবাচক। তাহলে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে। নেতিবাচক মনোভাব পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলবে। যেমনটি সুরা ইবরাহিমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর স্মরণ করো, যখন তোমাদের রব ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে আরো বেশি দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে নিশ্চয় আমার শাস্তি কঠোর।’ (সুরা ইবরাহিম: ০৭)

যেহেতু আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে কৃতজ্ঞ থাকব, তিনি আমাদের আরও দেবেন, ইনশাআল্লাহ। অর্থাৎ আমরা যদি খারাপ পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যের সাথে দায়িত্ব পালন করি, আল্লাহ তাআলা ওই পরিস্থিতি থেকে কিছু কল্যাণ বের করে আনবেন এবং পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত প্রশমিত হবে।

পুরস্কার সর্বদা পরীক্ষার চেয়ে বেশি
একটি পরীক্ষার পুরষ্কার সবসময় পরীক্ষার চেয়ে বেশিই হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘সুতরাং কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে, নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। (সুরা ইনশিরাহ: ৫-৬)
এখানে আল্লাহ আমাদের বলছেন যে যতটা পরীক্ষার মধ্য দিয়েই আমরা যাই না কেন, যদি পরীক্ষায় আমাদের মনোভাব সঠিক থাকে, তাহলে পুরস্কার হবে পরীক্ষার চেয়েও বড়!

এটি মাথায় রাখতে হবে যে, মহানবী (স.)-কে এবং সাহাবিদেরকে অনেক কঠিন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যেই মক্কায় প্রায় ১৩ বছর  ইসলাম প্রচারের পরও মাত্র মুষ্টিমেয় মুসলমান হয়েছিলেন, সেই মক্কাসহ পুরো আরব উপদ্বীপ হিজরতের মাত্র কয়েক বছরে ইসলামের উপদ্বীপে রূপান্তরিত হয়েছিল। মক্কায় নবীজির তীর্থযাত্রার সময় হাজার হাজার মুসলমান তাঁর সাথে ছিলেন।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি পরীক্ষায় মনোভাব সুন্দর রাখার আল্লাহর ওপর আস্থাশীল রাখার ও ধৈর্যের সাথে অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।