ধর্ম ডেস্ক
০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৪৬ পিএম
পবিত্র রমজান সিয়াম-সাধনার মাস, তাকওয়া অর্জনের মাস। এই মাস কোরআন নাজিলের মাস, গুনাহ মাফের মাস। রহমতের মাস, নাজাতের মাস। ঈমানদারদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের মাস পবিত্র রমজান। এই মাসে যত বেশি ইবাদত করা হবে, ততবেশি লাভ হবে। ঈমানদার বান্দাদের উচিত, এই মাসকে লুফে নেওয়া। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে; যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জনে করতে পার। (সুরা বাকারা: ১৮৩)
আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপরও রোজা ফরজ ছিল। একইভাবে আমাদের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, আশা করা যায় যে, এই মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তোমরা তাকওয়া বা পরহেজগারিতা অর্জন করতে পারবে। আমরা যেন খোদাভীরু বান্দা হতে পারি সেজন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমজান মাস দিয়েছেন। কিন্তু এই পবিত্র মাসেও অসংখ্য মানুষ গুনাহে লিপ্ত। দিনের বেলায় তারা পানাহার পরিত্যাগ করতে পারেনি। এই মাসে আমাদের উচিত ছিল, আল্লাহ তাআলাকে রাজি খুশি করার জন্য ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানো। কিন্তু দেখা যায় দিনের বেলা হোটেলে পর্দা টাঙিয়ে মানুষ খাবার খাচ্ছে। ওখানে কি সবাই অমুসলিম? না, এর অধিকাংশই মুসলমান।
খুব অবাক লাগে! রমজান মাস আমাদেরকে কিছু দিতে এসেছে, সেই মাসটিকে ইবাদতের মাধ্যমে আমাদের লুফে নেওয়ার কথা, যে মাস আমাদেরকে তাকওয়া শেখাতে এসেছে, সে মাসে আমরা দিনের বেলা প্রকাশ্যে খানা খাচ্ছি, আল্লাহকে একটু ভয় করছি না। যাদের ভেতর খোদাভীতি আছে, তারা কখনও দিনের বেলায় প্রকাশ্যে খাওয়াদাওয়া করতে পারে না।
এই সিয়াম সাধনার মাসে আমরা যেন ঠুনকো কোনো অজুহাতে, সামান্য দুনিয়াবি সমস্যার কারণে রোজা থেকে বিরত না থাকি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলে কারিম (স.) ঘোষণা করেছেন- وَمَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ অর্থ:‘.. যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানে রোজা পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ১৯০১)
সুবহানাল্লাহ! এজন্য এই রমজান মাসে আমাকে আপনাকে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলে কারিম (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তার মুখমণ্ডল জাহান্নামের আগুন থেকে ৭০ বছর দূরে সরিয়ে রাখবেন।’ (মুসলিম: ২৭৬৯)
রমজান মাস বড়ই নেয়ামতপূর্ণ মাস, বরকতপূর্ণ মাস, কোরআন নাজিলের মাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, شَهۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡهِ الۡقُرۡاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡهُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ ‘এটি হলো কোরআন নাজিলের মাস। আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রমজান মাসে কোরআন নাজিল করেছি। সমগ্র মানব জাতির হেদায়াতের জন্য এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)
রোজাদারদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস এই রমজান। রোজাদারের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদিস শরিফে রাসুলে কারিম (স.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত এই রমজান মাসে বর্ধিত করা হয়। এই রমজান মাসে একটি নফল অন্যমাসের একটি ফরজের সমতুল্য, একটি ফরজ ৭০টি ফরজের সমতুল্য। ১২টি মাসের মধ্যে সবচেয়ে দামি মাস এই রমজান।
রোজাদারের জন্য দুইটি খুশি। একটি হলো ইফতারের সময়। সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে, হালাল স্ত্রী থাকার পরও যৌন কামনা বাসনা থেকে বিরত থেকে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সময় রোজা রেখে, কিছু দেশ ১৬ ঘণ্টা, কোনো দেশ ১৮-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা রাখে আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং আল্লাহর ভয়ে। এজন্য ইফতার করার সময় রোজাদাররা আনন্দ লাভ করেন।
রোজাদারের জন্য আরেকটি খুশি, যেটি সবচেয়ে বড় খুশির সময়, সেটি হলো আল্লাহ তাআলার সঙ্গে দিদার বা সাক্ষাতের সময়। অর্থাৎ আল্লাহকে দেখার সময়টি রোজাদারদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
এছাড়াও রোজাদার ও রমজানের ব্যাপারে হাদিস শরিফে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা এসেছে। মূলত রমজান মাস আমাদেরকে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছে। যেভাবে রমজানে আল্লাহর ভয়ে কোনো খাবার মুখে নিলাম না, সেভাবে বাকি ১১ মাস সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
আসুন, আমরা এই মাসে পরিবর্তন হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহর রাসুল এই মাসে বেশি বেশি দান করতেন। আসুন, প্রত্যেকদিন আমরা কিছু টাকা-পয়সা পকেটে রাখি এবং কোনো দরিদ্র দেখলেই তাকে দান করি। বাড়িতে দরিদ্র, এতিম, মিসকিন, অসহায় মানুষ এলে তাদেরকে দান করি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘ওয়া আম্মাস সায়িলা ফালা তানহার’ কেউ চাইলে তাকে ফিরিয়ে দিও না। তাকে কিছু না কিছু দিয়ে বিদায় করি। কেউ যেন খালি হাতে ফেরত না যায়।
আল্লাহ তাআলা যাদেরকে ধনী বানিয়েছেন, আসুন হিসাব করে জাকাত প্রদান করি। আল্লাহ আপনাকে ধনী বানিয়েছেন। আপনি সেহেরি-ইফতারে দামি দামি খাবার খাচ্ছেন, আপনার প্রতিবেশী খাচ্ছে কি না, তারা কী খাচ্ছে সেই খোঁজ খবর নেওয়া আমার-আপনার ঈমানি দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। আসুন প্রতিবেশী, অসহায়, দরিদ্রদের খবর নিই।
এটি এমন মাস, যে মাসে আল্লাহ তাআলা কোরআন নাজিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘শাহারু রামাদানাল্লাজি উনঝিলা ফীহিল কোরআন’ ‘এটি এমন মাস, যে মাসে আমি কোরআন নাজিল করেছি।’ এই মাসের যে রাতে আল্লাহ তাআলা কোরআন নাজিল করেছেন, সেই রাতের এতই মূল্য যে, আল্লাহ তাআলা সে সম্পর্কে বলেন, ‘ইন্না আনঝালনাহু ফী লাইলাতুল কদর’ নিশ্চয়ই আমি লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিল করেছি। এরপর আল্লাহ তাআলা বলছেন, ওয়ামা আদরাকা মা লাইলাতুল কদর’ হে নবী আপনি জানেন এই কদর কী? এরপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেন, লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর। অর্থাৎ লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সুবহানাল্লাহ। এই হাজার বছরের হিসব করলে আমরা পাই ৮৩ বছর চার মাসের মতো হয়। লাইলাতুল কদরকে এর চেয়েও উত্তম বলা হয়েছে।
আসুন এই লাইলাতুল কদরে আমরা বেশি বেশি আমল করি। মূলত রমজান মাস অত্যন্ত কল্যাণকর ও বরকতময় একটি মাস। রমজান মাস আমাকে-আপনাকে তাকওয়া অর্জনের জন্য, একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার, মুত্তাকি বানানোর জন্য আল্লাহ তাআলা দান করেছেন।
কোরআন নাজিলের এই মাসে আমরা বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করব। এই রমজান যেন হয় কোরআনময়, রমজান যেন হয় সদকাময়, রমজান যেন হয় জাকাতময়। রমজানে সারাটি দিন যে আল্লাহর ভয়ে পানাহার থেকে বিরত থাকলাম, যে আল্লাহর ভয়ে অশ্লীল কাজ ও মিথ্যা বলার মতো গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকলাম, বাকি ১১ মাসও সেভাবে আমাদের চলতে হবে।
আসুন সিয়াম পালনের প্রত্যেকটি দিন তাওবা-ইস্তেগফার করি। নিজের অপরাধগুলো নিয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে আত্মসমর্পণ করি। এভাবে আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দা যেন হতে পারি। এই রমজান যেন আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়। এই রমজানে আমরা যেন নিজেদের গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারি আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। সিয়ামগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।