হারুন জামিল
১৮ মার্চ ২০২৩, ০২:৩০ পিএম
ধূসর পাহাড়ের গায়ে গড়িয়ে পড়ছিল পড়ন্ত সূর্যের আলো। নিচে দাঁড়িয়ে একখণ্ড আধুনিক সৌদি আরব। ডানে পাহাড়ের বর্ধিত অংশে দীপ্তিমান হয়ে আজও সগৌরবে শির উঁচু করে আছে ‘জাবালে নুর।’ সারা পৃথিবীর কাছে যা ‘আলোর পাহাড়’ হিসেবে খ্যাত। সমতল থেকে এক হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় কঠিন পাথরের হেরা পর্বত। পৃথিবীর মানুষ যাকে হেরা গুহা হিসেবে এক নামে চেনে।
জাবালে নুরের শীর্ষ চূড়ায় অবস্থিত একটি ছোট পরিসরের গুহার নামই হেরা। আরবিতে যাকে 'গারে হেরা' বলে। এখানেই দেড় হাজার বছর আগে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে এক রজনীতে আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইল আ. এসেছিলেন মানবজাতির জন্য হেদায়াতের পয়গাম নিয়ে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. মক্কানগরী থেকে দুই কিলোমিটার দূরের এই গুহায় নবুওয়াত লাভের পূর্বে নির্জনতার মাঝে আল্লাহর বন্দেগি করতেন। মহাবিশ্বের এক নিরঙ্কুশ স্রষ্টাকে খুঁজতেন। আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য, মানবজাতির দুঃখকষ্ট আর মুক্তির উপায় নিয়ে ভাবতেন। এই দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় মহানবী সা.—এর জন্য খাবার পৌঁছে যেতেন হজরত খাদিজাতুল কোবরা রা.। কী অসীম সাহস! কী আত্মত্যাগ! কী দৃঢ় মনোবল! সত্যের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য, মহান স্রষ্টাকে পাবার জন্য কী আকুলতা!
হেরা পর্বতের পাদদেশ থেকে দুশো ফিটের মতো উচ্চতায় উঠে হাঁপাচ্ছিলেন টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের সত্তোরর্ধ্ব আবদুল জব্বার। বলছিলেন, ‘আর পারুম না। বুক কাঁপে।’
অথচ এই নির্জন পাহাড়ে নবীজীকে দেখে যেতেন হজরত খাদিজাতুল কোবরা। তাকে সাহস জোগাতেন। নবীজী সা. নির্জনতার মাঝে এক আল্লাহকে খুঁজে প্রশান্তি অনুভব করতেন । ভাবলে আজও শিহরণ জাগে।
হেরা পর্বতে ওঠার জন্য প্রাচীন আমলে কোনো সিঁড়ি ছিল না। তেমন কোনো পথও ছিল না। যা ছিল তা বিপদসঙ্কুল-বন্ধুর। অথচ এরই পাথুরে পিচ্ছিল গা বেয়ে চূড়ার গহ্বরে নবীজী সা. নির্জনতার মাঝে আল্লাহকে ডাকতেন। উত্তর দিক থেকে এখনো প্রতিদিন হজ-ওমরাহ পালনকারী হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রথম কোরআন নাজিলের স্মৃতি বিজড়িত হেরা গুহা দেখতে আসেন। তারা আসেন পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে।
হেরা গুহা পরিদর্শন এখনো মোটেই সহজ নয়। আড়াই'শ ফুটের মতো উচ্চতার পর সিঁড়ি আছে। কিন্তু সে সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠতে শক্ত সামর্থ্যবান একজন মানুষেরও ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। অথচ উম্মুল মোমেনিন হজরত খাদিজা রা. সেই চূড়ায় পৌঁছে যেতেন। রাসুলে করিম সা. চল্লিশ দিন এই হেরা পর্বতে ধ্যানমগ্ন ছিলেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। হেরা পর্বত থেকে নবীজী সা. কাবা বায়তুল্লাহ দেখতে পেতেন। এরপর আকস্মিকভাবেই লাইলাতুল কদরে ফেরেশতা জিবরাইল আ. তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন। তিনি বলেন, হে মুহাম্মদ সা.! আপনি পড়ুন। উত্তরে নবী মুহাম্মদ সা. বলেন- আমি পড়তে জানি না। ফেরেশতা জিবরাইল তাঁকে আবারও বলেন- পড়ুন। তিনি বলেন, আমি পড়তে জানি না। বর্ণিত আছে, এভাবে তিনবার বলার পর রাসুলুল্লাহ সা.-কে আলিঙ্গন করেন জিবরাইল আমিন। এরপর মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. জিবরাইলের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে পড়েন- ‘ইক্বরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক্ব। খালাক্বাল ইনসানা মিন আলাক্ব। ইক্বরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাজি আল্লামা বিল ক্বালাম। আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম।’... পড়ুন। আপনার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট পানি থেকে। পড়ুন। আপনার রব মহিমান্বিত। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারা। মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’
মানব জাতির উদ্দেশে মহিমান্বিত আল কোরআনের এই আয়াতই ছিল প্রথম আল্লাহর বাণী। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. এই ঘটনার পর কিছুটা ভীতিবোধ করতে থাকেন। বিভিন্ন বর্ণনায় আছে, তিনি তাঁর ডানে বাঁয়ে যেদিকে তাকান জিবরাইল আ.কে দেখতে পান। সৃষ্টির উদ্দেশে মহান স্রষ্টার এই চিরন্তন বাণী নিয়ে হেরা পর্বত থেকে নেমে আসার সময় জিবরাইল মহানবীকে বলেন, মুহাম্মদ সা.! আপনি আল্লাহর রাসুল। আর আমি জিবরাইল। আল্লাহর বাণী বাহক।
ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় জাবালে নূর ত্যাগের সময় কল্পনার রাজ্যে একথা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। মনে হলো- কী দ্বীপ্তিময় জাবালে নূর!
জেবি