images

ইসলাম

তীব্র গরমেও হারামাইনের চত্বর শীতল কেন?

ধর্ম ডেস্ক

১৭ মার্চ ২০২৩, ১১:২৮ এএম

মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববির চত্বরে ব্যবহৃত পাথরের বিশেষ গুণ রয়েছে, যা পৃথিবীর অন্য কোনো পাথরের নেই। যারা হজ বা ওমরা করতে গেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন— চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো গরমেও খোলা আকাশের নিচে কাবাঘরের চারপাশের মেঝে ঠাণ্ডা থাকে। বিশেষ তাপ-শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই পাথর কোথা থেকে এলো এবং কে এর জোগানদাতা—এর পেছনে রয়েছে সুন্দর এক গল্প। 

গল্পটির প্রধান চরিত্রে যিনি, তিনি হলেন ড. মুহাম্মাদ কামাল ইসমাইল (১৯০৮-২০০৮)। একজন মিশরীয় প্রকৌশলী ও স্থপতি। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। মিশরের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন প্রথম সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষার্থী— যিনি হাইস্কুল শেষে ‘রয়েল স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ ভর্তি হয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ইউরোপে পাঠানো ছাত্রদের ভেতরেও তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ, ইসলামিক আর্কিটেকচার-এর ওপর তিনটি ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রথম মিশরীয় প্রকৌশলী।

পারিশ্রমিক ছাড়াই হারামাইন সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। অথচ পারিশ্রমিক গ্রহণের জন্য সৌদি বাদশাহ ফাহাদ এবং বিন লাদেন গ্রুপের সুপারিশ ছিল। তবুও তিনি কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি; এমনকি মোটা অংকের চেক তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন! বিন লাদেন কোম্পানির অংশীদার ইঞ্জিনিয়ার বাকার বিন লাদেনকে তিনি বলেছিলেন, ‘হারামাইন শরিফাইনের কাজের জন্য আমি পারিশ্রমিক নেব? তাহলে কেয়ামতের দিন আমি কীভাবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াব? কাবার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল এমনই নিখাদ ও অকৃত্রিম। সততা ও কাজের প্রতি আন্তরিকতা তাকে বাদশাহ ফাহাদ ও বাদশাহ আব্দুল্লাহসহ সকলের প্রিয়পাত্র ও বিশেষ আস্থাভাজন করে তুলেছিল।

১০০ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, মিডিয়ার লাইম লাইট থেকে দূরে সরে থেকে পুরো সময়টা তিনি দুই পবিত্র মসজিদের সেবায় ব্যয় করেন।

তিনি চেয়েছিলেন, সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে মসজিদুল হারামের মেঝে তওয়াফকারীদের জন্য ঢেকে দিতে। ইচ্ছা ছিল এমন মার্বেল বসানোর, যার তাপশোষণ ক্ষমতা রয়েছে। এই বিশেষ ধরনের মার্বেল তখনকার সময়ে সহজলভ্য ছিল না। এ ধরনের মার্বেল পুরো পৃথিবীতে কেবলমাত্র গ্রিসেের একটি ছোট পাহাড়েই ছিল। তিনি গ্রিসে গেলেন। পর্যাপ্ত পরিমাণে মার্বেল কেনার কন্ট্রাক্ট সাইন করলেন। ড. কামাল ইসমাইল গ্রিসেে কাজ শেষ করে মক্কা ফিরে এলেন এবং সাদা মার্বেলের সেই মজুদও চলে এলো। যথাসময়ে মসজিদে হারামের মেঝের বিশেষ নকশায় সাদা মার্বেলের কাজ সম্পন্ন হলো। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। অদূর ভবিষ্যতে ওই পাথর মসজিদে নববির চত্বরেও বসাতে হবে।

দীর্ঘ ১৫ বছর পর সউদি সরকার ড. কামালকে ডেকে মসজিদে নববির চারদিকের চত্বরও একইভাবে সাদা মার্বেল দিয়ে ঢেকে দিতে অনুরোধ জানালেন। ড. কামাল বলেন, ‘যখন আমাকে মসজিদে নববির প্রশস্ত চত্বরের মেঝেতেও একই মার্বেল ব্যবহার করে আচ্ছাদিত করে দিতে বলা হলো, তখন আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম! কারণ ওই বিশেষ ধরনের মার্বেল গোটা পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না কেবলমাত্র গ্রিসের একটি ছোট অঞ্চল ছাড়া। তাদের যতটুকু ছিল তার অর্ধেক তো আমি কিনে ফেলেছিলাম! কাজশেষে অবশিষ্ট যা ছিল সেটা মসজিদে নববির প্রশস্ত চত্বরের চাহিদার তুলনায় অল্প।

তিনি আবার গ্রিসে গেলেন। সেই একই কোম্পানির সি.ই.ও-এর সাথে দেখা করে জানতে চাইলেন, ওই পাহাড়ের আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে? সি.ই.ও তাকে জানালেন, ১৫ বছর আগে তিনি কেনার পরপরই পাহাড়ের বাকি মার্বেলটুকুও বিক্রি হয়ে যায়। শুনে তিনি এতটাই বিমর্ষ হলেন যে, কফি পর্যন্ত শেষ করতে পারলেন না! সিদ্ধান্ত নিলেন পরের ফ্লাইটেই মক্কা ফিরে যাবেন। অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কোনো কারণ ছাড়াই অফিস সেক্রেটারির কাছে জিজ্ঞেস করলেন, অবশিষ্ট মার্বেল কে ক্রয় করেছে? সেক্রেটারি বললেন, অনেক বছর হয়ে গেল। ক্রেতার নাম খুঁজে বের করা তো বেশ কঠিন। তখন আমি তাকে বললাম, আমি আরো একদিন গ্রিসে অবস্থান করব। সুতরাং আপনাকে ক্রেতার নাম খোঁজার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। 

এ কথা বলে হোটেলের টেলিফোন নম্বর দিয়ে তিনি চিন্তিত ও দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। আসার সময় ভাবলেন, কে কিনেছে তা জেনেই বা লাভ কী? আবার ভাবলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালো কিছুই রেখেছেন।

পরদিন এয়ারপোর্টে রওনা হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে কোম্পানির সেক্রেটারি ফোনে জানালেন, সেই ক্রেতার নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। কামাল ধীর-গতিতে অফিসের দিকে এগোতে এগোতে ভাবলেন, এই ঠিকানা কি আসলে আমার কোন কাজে আসবে? মাঝে যখন এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে...। অফিসে পৌঁছলে সেক্রেটারি তার হাতে ক্রেতার নাম-ঠিকানা দিলেন। ঠিকানা হাতে পেয়ে তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। তিনি আবিষ্কার করলেন যে, বাকি মার্বেলের ক্রেতা একটি সউদি কোম্পানি!

ড. কামাল সেদিনই সউদি আরবে ফিরে গেলেন। পৌঁছেই তিনি কোম্পানির মহাপরিচালকের সাথে দেখা করলেন এবং জানতে চাইলেন, অনেক বছর আগে গ্রিস থেকে ক্রয় করে আনা মার্বেলগুলো দিয়ে তিনি কী করেছেন? মহাপরিচালক কিছুই মনে করতে পারলেন না। কোম্পানির স্টোররুমের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে জানতে চাইলেন, যে সাদা মার্বেলগুলো গ্রিস থেকে আনা হয়েছিল সেগুলো দিয়ে কী করা হয়েছে? তারা জানাল, সেই সাদা মার্বেল পুরোটাই স্টকে আছে, কোথাও ব্যবহার করা হয়নি!

আনন্দে ড. কামাল শিশুর মতো ফোঁপাতে শুরু করলেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে পুরো গল্পটি তিনি কোম্পানির মালিককে শোনালেন। ড. কামাল তাকে একটি ব্ল্যাংক চেক দিয়ে তাঁর ইচ্ছামতো অংক বসিয়ে নিতে বললেন। কোম্পানির মালিক যখন জানলেন এই সাদা মার্বেল মসজিদে নববির জন্য নেওয়া হচ্ছে তখন তিনি এক দিরহামও নিতে সম্মত হলেন না!

কোম্পানির মালিক বললেন, আল্লাহর কসম যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নাই, আমার কাছে মজুদ সমুদয় মার্বেল আল্লাহর পথে দান করে দিলাম। আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়ে এটা কিনিয়েছিলেন এবং তিনিই আমাকে এটার কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন! কারণ এই মার্বেল রাসুলের মসজিদের উদ্দেশ্যেই এসেছে।

সূত্র: মিসরীয় ভূতত্ত্ববিদ ড. জগলুল আন-নাজ্জারের ফেসবুক পেজ (www.facebook.com/ZaghloolNajjar/posts/859330551171297) থেকে গৃহীত।