images

ইসলাম

কাজা নামাজ কি তাওবা করলে মাফ হয়?

ধর্ম ডেস্ক

১৬ মার্চ ২০২৩, ০৪:৫৩ পিএম

শয়তান ও নফসের ধোঁকায় পড়ে মানুষ প্রতিনিয়ত গুনাহের কাজ করে ফেলে। এমনকি গুনাহের সাগরে ডুবে যায় অনেকে। পরে ইবাদতের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং হতাশ হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় মুমিন বান্দার উচিত একনিষ্টচিত্তে আল্লাহর কাছে তাওবা করা। কেননা বান্দার গুনাহ পাহাড়সম হলেও আল্লাহ তাআলা তওবার কারণে তা ক্ষমা করে দেন। নবীজি (স.) বলেছেন– ‘সেই মহান সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! যদি তোমরা পাপ না করো, আল্লাহ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে (তোমাদের পরিবর্তে) এমন এক জাতি আনয়ন করবেন, যারা পাপ করবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করবে। আর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসলিম: ২৭৪৮)

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন..।’ (সুরা বাকারা: ২২২) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহসমূহ নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।’ (সুরা ফুরকান: ৭০)

সুতরাং গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করলে আল্লাহ তাআলা গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু কিছু গুনাহ এমন রয়েছে, যে গুনাহ তাওবা করলে মাফ হয় না। যেমন—ঋণ, জুলুম, গিবত ইত্যাদি। হাদিস অনুযায়ী নামাজও একপ্রকার ঋণ। কাজা আদায় না করলে এই ঋণেরও ক্ষমা নেই। এই ঋণ থেকে দায়মুক্তির পথ হলো— তা আদায় করা। আদায় না করলে ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এক মহিলা নবীজি (স.)-এর কাছে এসে বলল, আমার মা মান্নত করেছিলেন যে তিনি হজ করবেন। কিন্তু তা আদায় করার আগেই তিনি মারা যান। (এখন আমার করণীয় কী?) নবীজি (স.) ইরশাদ করেন, ‘তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ করে নাও। বলো তো, যদি তোমার মা কারো কাছে ঋণী হতেন তুমি কি তার ঋণ পরিশোধ করতে? মহিলা বলল, হ্যাঁ, তখন তার জবাবে নবীজি (স.) ইরশাদ করেন, তবে তোমরা আল্লাহর ঋণকেও পরিশোধ করো। কেননা, তিনি তাঁর প্রাপ্য পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। (সহিহ বুখারি: ১/২৪৯, নাসায়ি: ২/২)

এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা গেলো— যে ইবাদত বান্দার ওপর ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য, তা বান্দার ওপর আল্লাহ তাআলার পাওনা বা ঋণ। এই ঋণ থেকে দায়মুক্তির পথ হলো— তা আদায় করা। আদায় না করলে ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না। 

এক রাতে নবীজি (স.) তাঁর সাহাবিদের নিয়ে সফর করছিলেন। শেষ রাতে বিশ্রামের উদ্দেশে সফর বিরতি দিলেন। হজরত বিলাল (রা.)-কে ফজরের নামাজের জন্য জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে বিলাল (রা.)-ও তন্দ্রাবিভূত হয়ে গেলেন। ফলে সবার ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেল। নবীজি (স.) ঘুম থেকে জেগে সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পর সবাইকে নিয়ে ফজরের নামাজ কাজা করলেন। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামাজ ছুটে গেল, যখন সে জাগ্রত হবে, তখন সে যেন তা আদায় করে নেয়। (বুখারি: ৫৯৭; মুসলিম: ৬৮১)

নামাজ ফরজ ইবাদত এবং এর নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার বাণী اِنَّ الصَّلٰوۃَ کَانَتۡ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ کِتٰبًا مَّوۡقُوۡتًا ‘নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা নিসা: ১০৩) এই আয়াতে নামাজের সময়সীমা যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি কোনো নামাজ ছুটে গেলে পরবর্তী সময়ে ওই নামাজ কাজা করার বিষয়টিও পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই তো রাসুলুল্লাহ (স.) একে আল্লাহর ঋণ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। 

নবীজি (স.)-এর খন্দকের যুদ্ধের সময় কয়েক ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের কারণে সময়মতো পড়া সম্ভব হয়নি। এসব নামাজ তিনি কাজা হিসেবে পড়ে নিয়েছিলেন। (বুখারি: ১/১৬২, ২/৩০৭)

মুসলিম উম্মাহর সব মুজতাহিদ ইমাম এ ব্যাপারে একমত যে ফরজ নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় করা না হলে সময়ের পর তা কাজা করতে হবে। এ ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবে কাজা করা বা কোনো ওজরে কাজা হয়ে যাওয়া উভয় প্রকারের বিধানই সমান। যেমন মালেকি মাজহাবের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে আবদুল বার (রহ.) বিনা ওজরে অনাদায়কৃত নামাজ কাজা করা অপরিহার্য হওয়ার সপক্ষে শরয়ি প্রমাণাদি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 'ফরজ রোজার মতো ফরজ নামাজও সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কাজা করতে হয়। এ ব্যাপারে যদিও উম্মতের ইজমাই যথেষ্ট দলিল। যার অনুসরণ করা ওইসব বিচ্ছিন্ন মতের প্রবক্তাদের জন্যও অপরিহার্য ছিল। তারপরও কিছু দলিল উল্লেখ করা হলো- যথা নবীজি (স.)-এর বাণীগুলো। (আল ইসতিজকার: ১/৩০২-৩০৩)

সুতরাং কোন ব্যক্তির নামাজ কাজা হয়ে গেলে তাকে নামাজের কাজা আদায় করতে হবে; শুধু তাওবা করলে মাফ হবে না। তওবার দ্বারা ছুটে যাওয়া নামাজ মাফ হবে না। বরং সেগুলোর কাজা আদায় করা আবশ্যক। -(সহিহ বুখারি ১/৮৩; আল ইসতিযকার)

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, مَنْ ‌نَسِيَ ‌صَلَاةً ‌فَلْيُصَلِّهَا ‌إِذَا ‌ذَكَرَهَا، لَا كَفَّارَةَ لَهَا إِلَّا ذَلِكَ ‘কেউ যদি নামাজের কথা ভুলে যায়, সে যেন স্মরণ হওয়া মাত্রই তা আদায় করে নেয়। কেননা, তার কাফফারা একমাত্র সেই নামাজই।’ (সহিহ মুসলিম: ৬৮৪)

আনাস বিন মালিক বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন,  إِذَا رَقَدَ أَحَدُكُمْ عَنِ الصَّلاَةِ أَوْ غَفَلَ عَنْهَا فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَقُولُ أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজ ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়ে বা নামাজ থেকে গাফেল হয়ে যায়, তাহলে তার যখন বোধোদয় হবে তখন সে যেন তা আদায় করে নেয়। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-আমাকে স্মরণ হলে নামাজ আদায় করো।’ (সহিহ মুসলিম: ১৬০১; মুসনাদে আহমদ: ১২৯৩২; বায়হাকি কুবরা: ৪১৮২)

হাদিসের প্রত্যেক কিতাবে ‘বাবু কাজাইল ফাওয়ায়েত’ তথা ছুটে যাওয়া নামাজ কাজা করার অধ্যায় নামে কাজা নামাজ পড়ার পদ্ধতির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। কেননা কাজা নামাজ আদায় করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধান নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। নামাজের সকল মাসয়ালা জানার, বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।