images

ইসলাম

জুলুম অনেক বড় গুনাহ

ধর্ম ডেস্ক

২৩ মার্চ ২০২২, ০৫:১৭ পিএম

ইসলামে ‘মজলুম’ খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। জালেম ধ্বংস হয় মজলুমের বদদোয়ায়। মহানবী (স.) যাদেরকেই বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনকার্যের দায়িত্ব দিতেন, সবাইকে মজলুমের বদদোয়া থেকে সতর্ক করেছেন। অর্থাৎ সামান্য অসাবধানতার কারণে যেন কারো ওপর জুলুম না হয়ে যায়। মজলুমের আর্তনাদ আল্লাহর কাছে পৌঁছতে কোনো পর্দা ভেদ করতে হয় না।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (স.) যখন মুআজ (রা.)-কে ইয়েমেনে পাঠান, তাকে বলেন, ‘মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহর মধ্যে পর্দা থাকে না।’(বুখারি: ২৪৪৮)

মানবতার বিচারে জুলুম এতই অপছন্দনীয় যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নিজের জন্যও এটি হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম: ৬৭৩৭)

সমাজে বিরাজমান অত্যাচার-অনাচার ও বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতার মূল কারণ হলো জুলুম। একে অপরের ওপর নানা রকম অবিচারের ফলে আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর এ বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘জল ও স্থলভাগে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা মানুষের কর্মের ফলস্বরূপ।’ (সুরা রুম: ৪১)

অত্যাচারী হামান, কারূন, নমরূদ, ফেরাউন, আবু জেহেল, আবু লাহাব ও ইয়াজিদ দুনিয়াতে বেঁচে নেই। তবে তাদের আদর্শবাহী শাসক ও প্রভাব প্রতিপত্তিশালীদের অনেককে আজও দেখা যায়। পৃথিবীর সর্বত্রই শক্তিশালীদের হাতে দুর্বলদের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পাশাপাশি বয়স্ক, গর্ভবতী নারী ও শিশুরাও কেউ জুলুম নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অসহায় এতিম দুর্বলের ওপর অত্যাচারের কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতে বহু অত্যাচারী শাসক ও জাতি গোষ্ঠীকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এসব অত্যাচারী শাসক ও ব্যক্তিবর্গ কেয়ামত পর্যন্ত ঘৃণিত হতে থাকবে। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা জুলুম করেছে।’(সূরা ইউনুস: ১৩)।

জুলুমকারী ব্যক্তিরা ইসলামের পরিভাষায় সীমালঙ্ঘনকারী। সীমালঙ্ঘনের অপরাধে আল্লাহ ফেরাউনকে নীল নদের পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তাদের সবাইকেই আমি (তাদের) নিজ নিজ পাপের কারণে পাকড়াও করেছি, তাদের কারো ওপর প্রচণ্ড ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘাত হেনেছে, কাউকে আমি জমিনের নিচে গেড়ে দিয়েছি, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি’। (সুরা আনকাবুত :৪০)

দুনিয়া-আখেরাত কোথাও জালেমকে ছাড় দেওয়া হবে না। কেয়ামতের মাঠে জালেম বঞ্চিত হবেন সব ধরনের করুণা থেকে। একটি ছাগলও যদি অন্যায়ভাবে আরেকটি ছাগলকে শিং দিয়ে সামান্য আঘাত করে থাকে- আল্লাহ তাআলা সেদিন দুটি ছাগলকেই জীবিত করে জুলুমের শিকার প্রাণীকে সুযোগ করে দেবেন শিংধারী ছাগলকে আঘাত করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। অবলা প্রাণীর বেলায় যদি এই হয় দেনা-পাওনার হিসাব, তাহলে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ক্ষেত্রে হিসাবটা কেমন ভয়াবহ হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

‘যে ব্যক্তি জুলুমের মাধ্যমে কারো যে পরিমাণ জমি অন্যায়ভাবে দখল করে নেয়, কেয়ামতের দিন এর সাত গুণ জমি তার গলায় বেড়ি বানিয়ে দেয়া হবে।’(বুখারি ও মুসলিম: ২২৯১)

সুতরাং মজলুমের বদদোয়াকে ভয় করা এবং জুলুম থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ (তিরমিজি: ৩৫৯৮)

তাই কারো ওপর জুলুম হয়ে গেলে, যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অন্যথায় খোদায়ি শাস্তির অপেক্ষা করতে হবে। এমন যেন না হয় যে, মজলুমের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগেই আল্লাহর ডাক চলে আসে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—

‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, ওই দিন আসার আগে, যে দিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সে দিন তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে, তার জুলুমের পরিমাণ তার কাছ থেকে নেওয়া হবে আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে, তার প্রতিপক্ষের পাপ হতে নিয়ে তা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বুখারি: ২৪৪৯) 

তৎক্ষণাৎ দোয়া কবুল না হলে ব্যথাতুর হওয়ার কিছু নেই। উম্মতের এমন কৌতূহলের জবাব দিয়েই আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, আল্লাহ পাক জালিমকে ছাড় দিতে থাকেন, তারপর যখন ধরেন তখন আর তাকে কোনো সুযোগ দেন না। (বুখারি)

আল্লাহর রাসুল (স.)-এর এই হাদিসের স্বপক্ষে পবিত্র কুরআনে বেশ কিছু আয়াতও রয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি তাদেরকে অবকাশ দিয়ে রাখি। আমার কৌশল অতি শক্তিশালী।’(সূরা নুন: ৪৫)

আল্লাহ পাক আরও বলেন,  ‘জালেমরা যা করছে, সে সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে উদাসীন ভেবো না, তিনি তাদের ছাড় দিয়ে যাচ্ছেন ওই দিন পর্যন্ত, যেদিন চোখগুলো সব আতঙ্কে বড় বড় হয়ে যাবে’(সুরা ইবরাহীম: ৪৩) অন্য আয়াতে তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, এমনই ছিল তোমার রবের ধরপাকড়, যখন তিনি ধরেছিলেন ওই জালেম বসতিগুলোকে, নিশ্চয়ই তার ধরা অনেক কঠিন যন্ত্রণাময়। (সুরা হুদ: ১০২)

জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখেরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’(তিরমিজি: ২৫১১)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জালেমের জুলুম থেকে হেফাজত করুন। মজলুমের বদদোয়া পাওয়ার মতো গর্হিত গুনাহ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।