ধর্ম ডেস্ক
২২ মার্চ ২০২২, ০৩:৪০ পিএম
আল্লাহ তাআলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করে তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন। সকল বান্দার প্রতিই তাঁর দয়া অফুরন্ত। গুনাহগার বান্দাকে তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। আবার কোনো বান্দাকে তিনি খুব বেশি ভালোবাসেন আমল ও তাকওয়ার কারণে। ৪টি আলামত দেখেই চেনা যায় তাঁদের। নিচে হাদিসের আলোকে আলামতগুলো বর্ণনা করা হলো।
১) মানুষ তাকে ভালোবাসবে
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন জিব্রাইল (আ.)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাসো। রাবি বলেন, অতঃপর জিব্রাইল (আ.)-ও তাকে ভালোবাসতে থাকেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তাআলা অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন আকাশের অধিবাসীরাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। অতঃপর সেই বান্দার জন্য জমিনেও স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়। আর যখন আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন জিব্রাইল (আ.)-কে ডেকে বলেন যে, আমি অমুককে ঘৃণা করি, তুমিও তাকে ঘৃণা করো। রাবি বলেন, অতঃপর জিব্রাইল (আ.)-ও তাকে ঘৃণা করেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তাআলা অমুক ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন, তোমরাও তাকে ঘৃণা করো এবং আকাশবাসীরাও তার প্রতি ঘৃণাপোষণ করেন। অতঃপর তার জন্য জমিনেও ঘৃণা স্থাপন করা হয়।’(মেশকাত: ৫০০৫; মুসলিম ১৫৭-(২৬৩৭৮), সহিহুল জামে: ২৫৮৫; আহমদ; ৮৫০০)
এখানে উল্লেখ্য, অনেক বেঈমানকেও মানুষ ভালোবাসে, তাদের বহু সংখ্যক ফ্যান ফলোয়ার আছে, তাহলে তাদেরকেও কি আল্লাহ ভালোবাসেন? না। তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন না।
এখানে ‘জমিনওয়ালাদের ভালোবাসা’ বলতে মূলত ঈমানদার বা মুমিনদের ভালোবাসা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ যে বান্দাকে ভালোবাসেন, তাকে মুমিন বা নেককারদের পছন্দের ব্যক্তিতে পরিণত করবেন।
এখান থেকে বোঝা যায়, মুত্তাকি বা নেককার ব্যক্তিরা সবাই কাউকে ভালোবাসলে, বুঝতে হবে আল্লাহও তাঁকে ভালোবাসেন। আর আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করতে মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা চেয়ে বেড়ানোর দরকার নেই। সঠিক পথে চললে আল্লাহ তাআলাই তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন।
২) বিপদ-আপদ লেগে থাকবে, তবুও তিনি আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট
বিপদে মুসিবতে সন্তুষ্টচিত্তে থাকেন এমন বান্দাকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। ইবরাহিম (আ.)-এর অনেক পরীক্ষা নিয়েছেন মহান আল্লাহ। কোরআনের কোথাও বলা হয়নি যে, আল্লাহ তাআলা ফেরাউন কিংবা নমরুদের পরীক্ষা নিয়েছেন। বরং তিনি তাঁর ভালোবাসার বান্দাদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। তাই বহু ঈমানদারের জীবনে দেখবেন দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ লেগেই থাকে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে রাসুল (স.) বলেন, মুমিনের জন্য দুনিয়া কারাগারসদৃশ ও কাফিরের জন্য জান্নাতসদৃশ। (মুসলিম: ২৯৫৬)
আল্লাহর রাসুল (স.) আরও বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর কোনো বান্দার মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা করেন, তখন দুনিয়ায় তাকে তাড়াতাড়ি বিপদাপদের সম্মুখীন করেন। আর যখন তিনি কোনো বান্দার অকল্যাণের ইচ্ছা করেন, তখন তার গুনাহের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। অবশেষে কেয়ামতের দিন তাকে এর পরিপূর্ণ শাস্তি প্রদান করেন।
আর আল্লাহ তাআলা যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, তখন তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি থাকে, আর যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি থাকে’। (তিরমিজি: ২৩৯৬; সহিহাহ: ১২২০; মেশকাত: ১৫৬৫)
তখন সেই বান্দারাও এই পরীক্ষা ও মসিবতকে কল্যাণকর মনে করেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করিম (স.)-এর কাছে ছিলাম, তখন তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি তার ওপর আমার হাত রাখলে তর গায়ের চাদরের ওপর থেকেই তার শরীরের প্রচণ্ড তাপ অনুভব করলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কত তীব্র জ্বর আপনার। তিনি বলেন, আমাদের (নবী-রাসুলদের) অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। আমাদের ওপর দ্বিগুণ বিপদ আসে এবং দ্বিগুণ পুরস্কারও দেওয়া হবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কার ওপর সর্বাধিক কঠিন বিপদ আসে? তিনি বলেন, নবীদের ওপর। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! তারপর কার ওপর? তিনি বলেন, তারপর নেককার বান্দাদের ওপর। তাদের কেউ এতটা দারিদ্র্যপীড়িত হয় যে, শেষ পর্যন্ত তার কাছে তার পরিধানের কম্বল ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাদের কেউ বিপদে এত শান্ত ও উত্ফুল্ল থাকে, যেমন তোমাদের কেউ ধন-সম্পদ প্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ: ৪০২৪)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘কোনো ব্যক্তির জন্য বিনাশ্রমে আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদার আসন নির্ধারিত হলে আল্লাহ তার শরীর, সম্পদ অথবা সন্তানকে বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর সে তাতে ধৈর্যধারণ করলে শেষ পর্যন্ত বরকতময় মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত উক্ত মর্যাদার স্তরে উপনীত হয়। (আবু দাউদ: ৩০৯০)
৩) দুনিয়ামুখিতা থাকবে না
আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তার মধ্যে পদ-পদবী, অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি—এসব দুনিয়াবি কোনোকিছুতে তাঁর আকর্ষণ থাকবে না। আল্লাহ তাআলা কিছু বান্দাকে ভালোবেসে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। চাইলেও তাঁকে এসবকিছু দেওয়া হয় না। মূলত আল্লাহ তাআলা সেই বান্দাকে পরিকল্পিতভাবে দুনিয়াবি ফায়দা থেকে সরিয়ে রাখেন। সুবহানাল্লাহ। এবিষয়ে অনেক হাদিস পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে—
কাতাদা ইবনে নুমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তাকে দুনিয়া (প্রাচুর্য) থেকে বাঁচিয়ে রাখেন, যেমন তোমাদের কেউ তার রোগীকে (পানি স্পর্শ করলে যার অসুবিধা হবে,তাকে) পানি থেকে বাঁচিয়ে রাখে।’(তিরমিজি: ২০৩৬)
তবে, এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ কাউকে দুনিয়া দিলে তিনি আল্লাহর ঘৃণিত ব্যক্তি হয়ে যাবেন। প্রিয় বান্দাদের অনেককে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার প্রাচুর্যও দিয়েছেন। এসব ব্যক্তিদের মধ্যে ওসমান (রা.), সোলায়মান (আ.), দাউদ (আ.)সহ অনেকেই রয়েছেন। তবে তাঁদের কারো মধ্যেই দুনিয়াপ্রীতি ছিল না। এসব বান্দাদেরকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া দিয়েছেন, আবার ভালোবাসেনও।
৪) দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারী এবং নেক আমল করার অবারিত সুযোগ
আল্লাহ তাআলার ভালোবাসার বান্দার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হলো- তাঁকে আল্লাহ দ্বীনের বুঝ দান করবেন এবং সে অনুযায়ী বেশি বেশি নেক আমল করার সুযোগ দান করবেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—
‘আল্লাহ তাআলা যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করেন। আল্লাহই দানকারী আর আমি বণ্টনকারী।’ (বুখারি: ৭১; মুসলিম: ১০৩৭; মেশকাত: ২০০)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দার কল্যাণের ইচ্ছা করেন, তাকে মৃত্যুর আগে পবিত্র করেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, পবিত্র করেন কীভাবে? তিনি বললেন, মৃত্যুর আগে তাকে নেক আমলের তাওফিক দেন। অতঃপর তার উপর তার মৃত্যু ঘটান’। (সহিহুল জামে: ৩০৬)
আনাস (রা.) হতে বর্ণিত অপর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—
‘আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর বান্দা সম্পর্কে কল্যাণের ইচ্ছা করেন, তখন তাকে আমল করতে দেন। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল (স.)! কীভাবে তিনি আমল করতে দেন? তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে তিনি তাকে নেক আমলের তাওফিক দান করেন’। (তিরমিজি: ২১৪২; মেশকাত: ৫২৮৮)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দার কল্যাণ চান, তখন সে বান্দাকে সুমিষ্ট করেন। জিজ্ঞেস করা হলো সুমিষ্ট কী? তিনি বললেন, মৃত্যুর আগে ভাল কাজ তার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। অতঃপর এর উপরই তার মৃত্যু হয়’। (আহমদ: ১৭৮১৯; সহিহ ইবনে হিববান: ৩৪২; সহিহাহ: ১১১৪)
আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনাকে, মুসলিম উম্মাহর সবাইকে তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার মতো আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।