images

ইসলাম

মাতৃভাষায় কেমন দক্ষ ছিলেন নবী-রাসুলরা?

ধর্ম ডেস্ক

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:১৭ পিএম

মাতৃভাষা আল্লাহর দান এবং তাঁরই কুদরতের অংশ। বৈচিত্র্যময় ভাষা দিয়ে তিনি মানবজাতিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে।’ (সুরা রুম: ২২)

নবী-রাসুলদেরও প্রেরণ করা হয়েছে স্বজাতির ভাষা দিয়ে। তাঁরা নিজ নিজ ভাষায় কথা বলতেন এবং মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করতেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকে স্বজাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়।’ (সুরা ইবরাহিম: ০৪)

আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ২১৪১০)

নবী রাসুলরা মাতৃভাষার প্রতি অধিক যত্নশীল ও দক্ষ ছিলেন। তাঁরা শুধু ধর্ম প্রচারের কাজেই মাতৃভাষাকে ব্যবহার করেননি; বরং তাঁরা ছিলেন নিজ নিজ ভাষায় পাণ্ডিত্যের অধিকারী। সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আলংকারিক ভাষার কৃতিত্বধারী। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকে যা অনুমান করা যায়। কোরআনে মুসা (আ.)-এর ভাষ্যে হারুন (আ.)-এর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী, তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে।’ (সুরা কাসাস: ৩৪)

নবীজি (স.)-এর ভাষাগত দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) মহানবী (স.)-এর ভাষাগত দক্ষতা সম্পর্কে লেখেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মোবারক ভাষার বিশুদ্ধতা, একই বাক্যে বহু বাক্যের সমাবেশ, অভূতপূর্ব বাচনভঙ্গি, অমূল্য নির্দেশ ও সমাধান এত বেশি থাকত যা কোনো গবেষক ও চিন্তাবিদ কোনো সীমা ও গণনার মধ্যে আবদ্ধ করতে পারবে না। তাঁর ভাষার মাধুর্য, গভীরত্ব ও সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেননা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চেয়ে অধিক শুদ্ধ ও সুমধুর ভাষার অধিকারী আল্লাহ কাউকে সৃষ্টিই করেননি।

একবার ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মহানবী (স.)-কে জিজ্ঞাসা করেন যে হে আল্লাহর রাসুল, না আপনি বাইরে ভিনদেশে কোথাও গেছেন, না আপনি বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছেন, তবু আপনি এত সুন্দর শুদ্ধভাষা কোথা থেকে পেলেন? রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ইসমাইল (আ.)-এর ভাষা ও পরিভাষা যা দুষ্প্রাপ্য ও বিলীন হয়ে গিয়েছিল তা আমার কাছে জিব্রাইল (আ.) নিয়ে আসেন এবং তা আমি আত্মস্থ করেছি। উপরন্তু তিনি বলেন, আমার প্রভু আমাকে (আদব) ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন, ফলে আমার ভাষাকে অতি উত্তম করে দিয়েছেন। যে শিক্ষা আরবি ভাষা, তার শুদ্ধতা, অলংকার, সৌন্দর্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাকে আরবরা আদব বলে। (মাদারিজুন নুবুওয়াহ)

ঈসা, জাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আ.) অ্যারামিক ভাষায় কথা বলতেন। অ্যারামিক হলো সিরিয়াক ভাষার উপভাষা ও হিব্রুর প্রাচীনরূপ। মুসা ও হারুন (আ.) প্রাচীন মিসরীয় কিবতি ভাষায় কথা বলতেন। দাউদ ও সুলাইমান (আ.) অ্যারামিক ভাষায় কথা বলতেন। ইউসুফ (আ.) শৈশবে আরবি ভাষায় কথা বলতেন; মিসরে যাওয়ার পর প্রাচীন মিসরীয় ভাষা কিবতি ভাষায় কথা বলতেন। ইসমাইল, আইয়ুব ও শোয়াইব (আ.) আরবি ভাষায় কথা বলতেন। লুত, ইয়াকুব ও ইবরাহিম (আ.)-এর মাতৃভাষা ছিল সিরিয়াক। হুদ ও সালেহ (আ.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। নুহ, শিশ, ইউনুস ও ইদরিস (আ.) সিরিয়াক ভাষায় কথা বলতেন। পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী আদম (আ.) জান্নাতে আরবি ভাষায় কথা বলতেন; পৃথিবীতে আগমনের পর তিনি সিরিয়াক ভাষায় কথা বলেন। যাকে সিরিয়াক অ্যারামিক ভাষাও বলা হয়। 

ইবরাহিম, লুত, ইয়াকুব, ইউসুফ, দাউদ, সোলাইমান, আইয়ুব, শোয়াইব, মুসা, হারুন, ইউশা বিন নুন, জাকারিয়া, ঈসা, ইয়াহিয়া (আ.) প্রত্যেকে নিজ নিজ মাতৃভাষার পাশাপাশি আরবিতেও দক্ষ ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। কোরআনের ভাষাও আরবি।

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওপর অবতীর্ণ ঐশীগ্রন্থের ভাষার প্রাঞ্জলতা দেখে সমকালীন কবি-সাহিত্যিকরা বিস্মিত হয়েছিলেন। তখন আরবদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ পবিত্র কোরআনের ভাষার লালিত্য ও নৈপুণ্য এবং সর্বোপরি ইসলামের যুগোপযোগী মর্মবাণী উপলব্ধি করে আরববাসী নতুন ধর্মের প্রতি আস্থা স্থাপন করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি কোরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি আল্লাহভীরুদের সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন।’ (সুরা মরিয়ম: ৯৭)

আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশপাশের লোকদের সতর্ক করেন এবং সতর্ক করেন সমাবেশের দিন সম্পর্কে।’ (সুরা শুরা: ৭)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নিজ নিজ ভাষায় সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন এবং বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় স্বগোত্রীয় মানুষকে দ্বীন প্রচারের তাওফিক দান করুন। আমিন।