ধর্ম ডেস্ক
২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৩২ পিএম
আরবি ‘জানাজা’ শব্দের অর্থ মৃতদেহ। আর সালাতুল জানাজা মানে মৃতদেহের নামাজ। কোনো মুসলমান মারা গেলে তার মাগফেরাতের জন্য তার মৃতদেহ সামনে নিয়ে বিশেষ নিয়মে যে দোয়া করা হয় তারই নাম জানাজার নামাজ। পবিত্রতা ছাড়া জানাজার নামাজ পড়া যায় না। এ নামাজ শুধু পুরুষদের জন্য আবশ্যক। নারীদের জন্য এতে অংশগ্রহণের বিধান নেই।
জানাজার নামাজের গুরুত্ব
কোনো মুসলমান মারা গেলে তার জানাজার নামাজ পড়া এবং তার কবর জিয়ারত করা সওয়াবের কাজ। এমনকি পাপাচারী মুসলমান মৃত্যুবরণ করলেও তার জানাজা পড়তে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর (জানাজার) নামাজ পড়া ওয়াজিব, চাই সে নেককার হোক বা বদকার, যদিও সে কবিরা গুনাহ করে।’ (আবু দাউদ: ১/৩৫০)
ইসলামি শরিয়তে জানাজা, কাফন-দাফন ইত্যাদি জীবিত মুসলমানদের ওপর মৃতদের অধিকার। জানাজার নামাজ পড়া ফরজে কেফায়া তথা সামগ্রিক ফরজ। যদি সমাজের একদল মানুষ মৃত ব্যক্তির জানাজা আদায় করে, তবে সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ তা আদায় না করলে সবাই গুনাহগার হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘একজন মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকার রয়েছে। এক. যখন কোনো মুসলমানের সঙ্গে দেখা হয় তখন সালাম দেবে। দুই. কোনো মুসলমান ডাকলে সাড়া দেবে। তিন. সে তোমার কাছে সৎ পরামর্শ চাইলে তুমি তাকে সৎ পরামর্শ দেবে। চার. কোনো মুসলমানের হাঁচি এলে হাঁচিদাতা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে। পাঁচ. কোনো মুসলমান অসুস্থ হলে তার সেবা-শুশ্রূষা করবে। ছয়. কোনো মুসলমান মৃত্যুবরণ করলে তার জানাজায় শরিক হবে।’ (সহিহ মুসলিম: ২১৬২)
জানাজার নামাজের ফজিলত
রাসুলুল্লাহ (স.) জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মৃতের জন্য সালাত আদায় করা পর্যন্ত জানাজায় উপস্থিত থাকবে, তার জন্য এক কিরাত, আর যে ব্যক্তি মৃতের দাফন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে তার জন্য দুই কিরাত। জিজ্ঞাসা করা হলো দুই কিরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বিশাল পর্বত সমতুল্য (সওয়াব)।’ (সহিহ বুখারি: ১৩২৫)
জানাজায় উপস্থিত হওয়ার মাধ্যমে জীবিত ব্যক্তিদের ভেতর মৃত্যুর স্মরণ জাগ্রত হয়। আর মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখে। বারা (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে এক জানাজায় উপস্থিত ছিলাম। তিনি কবরের কিনারে বসে কাঁদলেন, এমনকি তাঁর চোখের পানিতে মাটি ভিজে গেল। অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়েরা, তোমাদের অবস্থাও তার মতোই হবে, সুতরাং তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৯৫)
জানাজাসহ চার আমলে নিশ্চিত জান্নাত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) একদিন বললেন, তোমাদের মধ্যে আজ কে সিয়ামরত ছিলে? আবু বকর (রা.) বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ জানাজায় শরিক হয়েছ? আবু বকর (রা.) বললেন, আমি। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ দরিদ্রকে আহার দিয়েছ? আবু বকর (রা.) বললেন, আমি। তিনি বললেন, আজ তোমাদের কেউ কোনো অসুস্থকে দেখতে গিয়েছ? আবু বকর (রা.) বললেন, আমি। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, এ কাজগুলো যদি কোনো মানুষের মধ্যে একত্রিত হয়, তাহলে সে ব্যক্তি অবশ্যই জান্নাতি হবেন। (সহিহ মুসলিম: ২/৭১৩, হাদিস: ১০২৮, কিতাবুজ জাকাত)
জানাজার নামাজের নিয়ম
১. প্রথম তাকবিরের পর ছানা পড়া।
২. দ্বিতীয় তাকবিরের পর দরুদ পড়া।
৩. তৃতীয় তাকবিরের পর দোয়া পড়া।
৪. চতুর্থ তাকবিরের পর সালাম ফেরানো।
শুধু প্রথম তাকবিরে হাত উঠাবে আর কোনো তাকবিরে হাত উঠানোর বিধান নেই।
জানাজার নামাজের ফরজ ও সুন্নত
জানাজার নামাজের ফরজ দুইটি। এক. চারবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলা। দুই. দাঁড়ানো। জানাজা সহিহ হওয়ার জন্য লাশ উপস্থিত থাকা শর্ত। জানাজার সুন্নত তিনটি। এক. আল্লাহর হামদ ও সানা পড়া। দুই. নবীজি (স.)-এর ওপর দরুদ পড়া। তিন. মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা। (ইলাউস সুনান: ৮/১৭৪)
জানাজার নামাজের পদ্ধতি ও দোয়া
ইমাম মৃতের বক্ষ বরাবর দাঁড়াবে। (বুখারি: ১২৪৬)। ইমামের পেছনে মুক্তাদিদের কাতার হবে। (ইবনে হিব্বান: ৩১০২)। সবাই আল্লাহর ইবাদত হিসেবে জানাজার ফরজ আদায়ের নিয়ত করবে। (বুখারি: ১) উল্লেখ্য, নিয়ত মনে মনে করা ফরজ। মুখে পড়া ফরজ নয়। তাই মনে মনে শুধু এতটুকু নিয়ত করলেই হবে যে জানাজার নামাজ ফরজে কেফায়াহ, চার তাকবিরের সাথে এই ইমামের পেছনে আদায় করছি। নামাজ আল্লাহর জন্য, দোয়া মাইয়্যেতের জন্য। এরপর তাকবিরে তাহরিমা বলবে এবং কান পর্যন্ত হাত ওঠাবে। এরপর ছানা পড়বে। এরপর তাকবির বলে দরুদ পাঠ করবে। এই তাকবিরে হাত ওঠাবে না। তারপর তৃতীয় তাকবির বলে মৃত ব্যক্তি ও মুসলমানদের জন্য দোয়া করবে। তখনও হাত ওঠাবে না। মৃত ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক হলে নিম্নস্বরে এই দোয়া পড়তে হয়- ‘আল্লাহুম্মাগ ফিরলি হায়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া সাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াহতাহু মিন্না, ফাআহয়িহী আলাল ইসলামি ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহ আলাল ইমান।’ মৃত ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলে এই দোয়া পড়বে—‘আল্লাহুম্মাজ আলহু লানা ফারাতাও ওয়াজ আলহু লানা আজরাও ওয়াজ আলহু লানা শাফিআও ওয়া মুশাফফাআ।’
তারপর চতুর্থ তাকবির বলবে। তখনও হাত ওঠাবে না। (দারাকুতনি: ১৮৫৩, ইবনে আবি শায়বা: ৩/২৯৫)। অতঃপর ডান ও বাম দিকে সালাম ফেরাবে। (সুনানে কুবরা: ৭২৩৮)
ইমাম উচ্চৈঃস্বরে তাকবির বলবে এবং বাকি দোয়া-দরুদ অনুচ্চস্বরে পড়বে। মুক্তাদিরা সবই অনুচ্চস্বরে করবে। (আবু দাউদ: ২৭৮৪, সুনানে কুবরা: ৭৪৩৩)
জানাজার আরবি দোয়া, উচ্চারণ ও অর্থ
তৃতীয় তাকবিরের পর প্রাপ্তবয়স্ক মৃত ব্যক্তির জন্য যে দোয়া পড়তে হয় তার আরবি হলো- اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِ نَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَاُنْثَنَا اَللّٰهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَاَحْيِهِ عَلٰى الْاِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلٰى الْاِيْمَانِ উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগ ফিরলি হায়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া সাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াহতাহু মিন্না, ফাআহয়িহী আলাল ইসলামি ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহ আলাল ইমান। অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ছোট ও বড় এবং পুরুষ ও নারী সকলকে ক্ষমা করে দিন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মধ্য থেকে যাদেরকে জীবিত রেখেছেন ইসলামের উপর জীবিত রাখেন আর যাদেরকে মৃত্যু দান করেছেন তাদেরকে ঈমানের সঙ্গেই মৃত্যু দান করেন।’
অপ্রাপ্তবয়স্ক মৃতব্যক্তির জন্য যে দোয়া পড়তে হয় তার আরবি হলো- اَللّٰهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرَطًا وَّاجْعَلْهُ لَنَا اَجْرً ا وَّاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَّمُشَفِّعًا উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মাজ আলহু লানা ফারাতাও ওয়াজ আলহু লানা আজরাও ওয়াজ আলহু লানা শাফিআও ওয়া মুশাফফাআ।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আপনি তাকে আমাদের জন্য অগ্রবর্তী হিসেবে কবুল করুন, তাকে করুন আমাদের জন্য প্রতিদান স্বরূপ এবং তাকে বানান আমাদের জন্য সুপারিশকারী -যার সুপারিশ কবুল করা হবে।’ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে হলে ‘হু’ (هُ) স্থানে ‘হা’ (هَا) বলতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সুন্নাহসমর্থিত পদ্ধতিতে যথাযথ নিয়মে জানাজার নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।