ধর্ম ডেস্ক
১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৯ এএম
টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা হলো তাবলিগ জামাতের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এখান থেকেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ইসলাম প্রচারে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েন তাবলিগের সাথিরা। ৫৬ বছর ধরে টঙ্গীতে আয়োজিত হয়ে আসছে বিশ্ব ইজতেমা। এর সূচনা ও বিকাশ কীভাবে, বাংলাদেশে কেন এত বড় আয়োজন—সংক্ষেপে তা এখানে তুলে ধরা হলো।
উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তাবলিগ জামাতের শুভ সূচনা হয়। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের মোজাফফরনগর জেলায় জন্ম নেওয়া ইসলামি চিন্তাবিদ ও সাধক মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ) এই ধারার প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৬ সালে এই জামাত আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করলেও এর প্রস্তুতি চলছিল ১৯২৪ সাল থেকেই।
মাওলানা ইলিয়াস তখন উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর মাজাহেরুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন এবং সাহারানপুরের বাংলাওয়ালি মসজিদে ওয়াজ-নসিহত করতেন। সেখানে পাশের মেওয়াত নামক গ্রাম থেকে লোকজন আসতেন। তাদের অনুরোধে তিনি মেওয়াত যান এবং সেখানে কয়েক শ মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তিনি অনুভব করলেন- মক্তবগুলোতে সীমিতসংখ্যক মুসলমান ইসলামের শিক্ষা নিচ্ছে, এর বাইরে বিপুলসংখ্যক মুসলমান ধর্মের মৌলিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তাদের জন্য তিনি ইসলাম প্রচারের এমন এক পদ্ধতির কথা ভেবেছেন, যার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমানের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে যাবে এবং তারা নিজেদের শুদ্ধ করতে পারবে।
এমন চিন্তা থেকেই তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর পরিশ্রম করে মূলত তাবলিগ জামাতকে বিশ্বব্যাপী সফল দাওয়াতি মিশন হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের অনুমান অনুসারে, ১৫০টিরও বেশি দেশে প্রায় ৮ কোটি তাবলিগ জামাতের অনুসারী রয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করেন।
মাওলানা ইলিয়াসের এই দাওয়াতি মিশন সম্পর্কে ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাসান আলি নদভি বলেন, ‘দরবেশ আলেম ইলিয়াস শুধু মেওয়াতেই নন, পুরো বিশ্বে এক শুদ্ধবাদী বিপ্লবের সূচনা করেছেন, যার নজির ইসলামের ইতিহাসে বিরল।’ (বায়োগ্রাফি অব মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস)
প্রতিষ্ঠার পরপরই উপমহাদেশের সাধারণ মুসলমানদের আস্থা কুড়াতে সক্ষম হয় তাবলিগ জামাত। ফলে ভারতবর্ষের তৎকালীন বাংলা অঞ্চলেও এই দাওয়াতি মিশন ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে মাওলানা আবদুল আজিজের তত্ত্বাবধানে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে ১৯৪৬ সালে তাবলিগের প্রথম ইজতেমা আয়োজিত হয়। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তাবলিগ জামাতের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে প্রথমবার টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে ইজতেমা আয়োজিত হয়। তখন থেকে অন্যান্য দেশ থেকেও মুসল্লিরা ইজতেমায় যোগ দেওয়া শুরু করেন। এরপর প্রতি বছর তুরাগ নদীর উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ১৬০ একরের বিশাল মাঠে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশের লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নেন।
কিন্তু বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে কেন? এ ব্যাপারে বিশ্লেষকদের বিভিন্ন মন্তব্য পাওয়া যায়। কেউ বলেন, এটি লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। আবার কেউ বলেন, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ তাই বাংলাদেশে ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আবদুর রশিদ বলেন, ‘বিশ্ব ইজতেমা মূলত সুন্নি মুসলমানদের সমাবেশ। ভারত ও পাকিস্তানে মাঝেমধ্যে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা বাধে, কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। তাই বাংলাদেশকেই ‘বিশ্ব ইজতেমা’র আয়োজক দেশ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের আগে একপর্বে তিনদিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হত। ব্যাপক উপস্থিতি, জনদুর্ভোগ ইত্যাদি চিন্তা করে আইন-শৃ্ঙ্খলা ও নিরাপত্তার তাগিদে তাবলিগের শুরা সদস্যদের পরামর্শের ভিত্তিতে তিন দিন করে দুই ধাপে ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর বিরতি দিয়ে ২০২৩ সালে প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি, শেষ হচ্ছে আজ ১৫ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ২০ জানুয়ারি, যা ২২ জানুয়ারি শেষ হবে।