ধর্ম ডেস্ক
০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৪১ এএম
তালাক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় বৈধ বিষয়। ইসলাম পবিত্র সম্পর্ক রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করার তাগিদ দেয়। একেবারে অনন্যোপায় হলে বা তালাক দেওয়াটা কল্যাণকর হলেই কেবল তালাকের অনুমতি দেয়। তাতেও রয়েছে সুন্দর পরামর্শ। আসুন দেখে নিই তালাক দেওয়ার সঠিক, সুন্দর ও নিরাপদ নিয়মটি।
তালাক দেওয়ার সঠিক ও সুন্দর পদ্ধতি
কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম ও সুন্দর পদ্ধতি হলো— স্ত্রী যখন হায়েজ (মাসিক) থেকে পবিত্র হবে, তখন স্বামী তার সঙ্গে সহবাস না করে সুস্পষ্ট শব্দে এক তালাক দেবে। যেমন—‘আমি তোমাকে তালাক দিলাম’। এরপর স্বামী যদি স্ত্রীকে ইদ্দত চলাকালীন ফিরিয়ে নিতে চায়, তাহলে তা পারবে। পুনরায় সম্পর্ক কায়েম করতে না চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। তখন স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে। ইদ্দতের সময় হলো—গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত, আর গর্ভবতী না হলে তিন হায়েজ (মাসিক) অতিক্রম হওয়া পর্যন্ত। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তালাকপ্রাপ্ত নারী তিন ঋতুস্রাব পর্যন্ত নিজেদের বিরত রাখবে’ (সুরা বাকারা: ২২৮)। আর ‘গর্ভবতীদের সময়কাল হলো- সন্তান প্রসব করা।’ (সুরা তালাক: ৪)
সঠিক পদ্ধতিতে তালাক দেওয়ার সুফল
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তালাকের পরে দাম্পত্যজীবনের সুখ-শান্তির কথা মনে পড়ে পরস্পরের গুণ ও অবদান স্মরণ করে উভয়েই অনুতপ্ত হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করার চেষ্টা করে। যদি শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী এক তালাক দেওয়া হয়, তাহলে এ আশা পূরণ হওয়ার সুযোগ থাকে এবং পুনরায় বৈবাহিক জীবন শুরু করতে পারে। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে তালাক দিলে প্রথমত স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণের অবকাশ পাওয়া যায়। আর যদি ইদ্দত শেষ হয়ে বিচ্ছেদও সম্পন্ন হয়, তবুও আবার তারা দাম্পত্যজীবনে ফিরে আসতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে নতুন মোহরানা ধার্য করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, দ্বিতীয়বারও তাদের মাঝে বনিবনা না হলে এবং পুনরায় তালাকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশনার পূর্ণ অনুসরণ করে ওই সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
তবে, দ্বিতীয় বার তালাকের পর স্বামীকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, খুব হিসাব-নিকাশ করে চলতে হবে। কেননা এখন শুধু একটি তালাক তার অধিকারে আছে। সারাজীবনের জন্য শুধুমাত্র একটি তালাক। কোনো কারণে আরেকবার তালাক দিলেই আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না এবং পুনরায় বিয়েও করতে পারবে না, বরং সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যাবে। কেননা এই সুযোগ দুই তালাক পর্যন্তই সীমিত করে দিয়েছে শরিয়ত।
সঠিক পদ্ধতি না মানার কুফল
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ শরিয়তের উল্লেখিত সুন্দর পদ্ধতি মানে না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব শ্রেণির লোকদের মধ্যেই একটি প্রবণতা দেখা যায় যে তারা যখন রাগে-ক্ষোভে লিখিত বা মৌখিকভাবে তালাক দেয় তখন একসঙ্গে তিন তালাকই দিয়ে থাকে। তিন তালাক দিলে ইদ্দত চলাকালীনও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং ইদ্দতের পরেও নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে না। একে অন্যের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আপসের জন্য আগ্রহী হলেও তা কাজে আসে না।
একসাথে তিন তালাক দেওয়া কিংবা বিভিন্ন সময় তালাক দিতে দিতে তিন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া হারাম। আল্লাহ তাআলা এর শাস্তি হিসেবে এই বিধান দিয়েছেন যে, তারা পুনরায় একসাথে বসবাস করতে চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর অন্যত্র তার বিয়ে হওয়া এবং পরবর্তী স্বামীর সঙ্গে তার মিলন হওয়া অপরিহার্য। এরপর কোনো কারণে সে তালাকপ্রাপ্তা হলে কিংবা ওই স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত পালনের পর এরা দুজন নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। (সুরা বাকারা: ২৩০)
রাগ বা ঠাট্টাচ্ছলেও তালাক নয়
মনে রাখতে হবে, ‘রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়’ (আদ্দুররুল মুখতার: ৪/৪৫২)। ইবনু হাজার আসকালানি (রহ) বলেন, ‘সাধারণত মানুষ রাগান্বিত হয়েই তালাক দেয়।’ (ফাতহুল বারি: ১০/৪৮৯)
এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তিন জিনিস ঠাট্টা করে করলেও পতিত হয়ে যায়। বিবাহ, তালাক ও ‘তালাকে রজঈ’ ফেরত নেওয়া।’ (আবু দাউদ: ২১৯৪)
আসলে ইসলামে তালাক খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এ কারণেই বিয়ের আগে তালাকের মাসয়ালা ভালোভাবে জেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। অবশ্য কেউ যদি প্রচণ্ড রেগে যায় ও রাগের ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আর এ অবস্থায় সে কী বলেছে কিছুই মনে না থাকে তাহলে ওই অবস্থার তালাক কার্যকর হবে না।
অনেকের ধারণা, তালাকের সময় সাক্ষী না থাকলে তালাক পতিত হয় না। এটি মনগড়া কথা। সাক্ষীর প্রয়োজন হয় বিয়ের সময়। তালাকের জন্য এক বা একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই।
তালাকের মাসয়ালা না জানা ব্যক্তিদের জন্য ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করাও ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আগেভাগেই আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কারণ বাস্তবেই যদি বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় এরপরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসঙ্গে বাস করে তাহলে তা হবে কবিরা গুনাহ এবং উভয়েই ব্যভিচারের গুনাহে লিপ্ত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মানার তাওফিক দান করুন। শরিয়তের সুন্দর পরামর্শগুলো গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।