images

ইসলাম

ইসলামে নারীকে উপেক্ষার সুযোগ নেই

ধর্ম ডেস্ক

০৮ মার্চ ২০২২, ১১:১৬ এএম

নারী ও পুরুষের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। সর্বোচ্চ সম্মান ইসলামই নারীদের দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ‘নিসা’ অর্থাৎ নারী নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা রয়েছে। যেখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে নারীর অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে। এছাড়াও কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও তাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ‘তোমরা তাদের (নারীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও।’ (সুরা নিসা: ১৯)

নারীকে উপেক্ষা করে মানবতার জন্য যে কর্মসূচি তৈরি হবে তা হবে অসম্পূর্ণ। এমনকি নারীকে উপেক্ষা করে সামাজিক ভারসাম্যও রক্ষা হবে না। আল্লাহ তায়ালা সুরা হুজরাতের ১৩নং আয়াতে ঘোষণা করেন—

‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন’।

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। “নারী-পুরুষের সমতা, টেকসই আগামীর মূল কথা” (Gender equality today for a sustainable tomorrow)—এই প্রতিপাদ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হচ্ছে।

ইসলামে মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ সমান। মুসলমান হিসেবেও সমান। ইলম শিক্ষা করা (জ্ঞান অর্জন করা) উভয়ের জন্য ফরজ। উভয়ের জন্য হালাল-হারামের সীমানা নির্দিষ্ট। উভয়ের মতামত দেওয়া ও সমালোচনার অধিকার সমান। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে রয়েছে—

‘তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭) মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন, নারীদের তেমন ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের ওপর পুরুষদের।’ (সুরা বাকারা: ২২৮)

 সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন, তাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যাওয়া ধন-সম্পদের পুরুষদের যেমন অংশ রয়েছে, (একইভাবে) নারীদের জন্যও (সে সম্পদে) অংশ রয়েছে’। (সুরা নিসা: ৭)

মা হিসেবে ইসলাম নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত’। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক লোক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি হকদার কে? নবীজি (স.) বললেন, ‘তোমার মা’। ওই লোক জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’। ওই লোক আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবারও তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’। (বুখারি)

ইসলামে কন্যাসন্তানের জন্মকে সুসংবাদ বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মেয়েশিশু বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক।’ হাদিসে আরও রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি দুটি কন্যাকে তারা সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কেয়ামতের দিন আমি এবং সে এ দুটি আঙ্গুলের মতো পাশাপাশি আসবো (অতঃপর তিনি তার আঙ্গুলগুলো মিলিত করে দেখালেন)’। (মুসলিম: ২৬৩১; তিরমিজি: ১৯১৪; মুসনাদ আহমদ: ১২০৮৯; ইবনু আবি শাইবা: ২৫৯৪৮)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলনে, রাসুল (স.) ইরশাদ করনে, ‘যার ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলো, অতঃপর সে ওই কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, মেয়ের ওউপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবশে করাবেন। ’ (মুসনাদ আহমদ: ১/২২৩)

একসময় কন্যাশিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, কন্যাসন্তানের জন্মের সংবাদে পিতা মানহানিকর মনে করে বিমর্ষ হতো।

সে প্রসঙ্গও কোরআনে এসেছে এভাবে—‘তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের ‘সুসংবাদ’ দেয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে) হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত’। (সুরা নাহল: ৫৮-৫৯)

কোরআনের আয়াতে কন্যা সন্তানের জন্মকে বলা হচ্ছে ‘সুসংবাদ’। দুঃখজনক হলেও সত্য, আধুনিক জাহেলি যুগে নারীর জন্ম কখনো কখনো ‘সুসংবাদ’ নয়। পুঁতে ফেলা হয় জন্মের আগেই। ভ্রুণহত্যা যে কত ভয়াবহ গুনাহের কাজ, তাও বিবেকে নাড়া দেয় না। বিজ্ঞানের কল্যাণে যখন জানতে পারে যে, আগত শিশু নারী, তখন তাকে হত্যা করা হয়। অথচ আল্লাহ বলছেন—

‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। আমিই জীবিকা দিই তাদের এবং তোমাদের। নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মহাপাপ’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩১)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে?’ (সুরা তাকভির: ৮-৯)

স্ত্রীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (স.) ইরশাদ করেন, উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক। (মুসলিম শরিফ)। তিনি আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম (তিরমিজি)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করো’ (সুরা নিসা: ১৯)। কোরআনে আরও বলা হয়েছে—

ইসলামে নারীকে সম্মান করা ব্যক্তিত্বের প্রতীক

হাদিসে এসেছে, নারীকে সম্মান করার পরিমাপের ওপর ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে। তিনটি বিষয় নবী কারিম (স.)-এর জীবনে লক্ষণীয় ছিল- এক. নামাজের প্রতি অনুরাগ; দুই. ফুলের প্রতি ভালোবাসা; তিন. নারীর প্রতি সম্মান। (বুখারি ও মুসলিম)।

নারী তাঁর নারীত্বের মর্যাদা বজায় রেখেই সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন। নারী ছাড়া অন্য কেউই মাতৃত্বের সেবা ও সহধর্মিণীর গঠনমূলক সহযোগী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়। মায়েদের ত্যাগ ও ভালোবাসা ছাড়া মানবীয় প্রতিভার বিকাশ ও সমাজের স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মায়েরাই সমাজের প্রধান ভিত্তি তথা পরিবারের প্রশান্তির উৎস। ইসলামে নারীকে নারী হওয়ার কারণে বা পুরুষকে পুরুষ হওয়ার কারণে বিচারে তারতম্য হবে না। বিশুদ্ধ আমলই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য। মহান আল্লাহ বলেন—

পুরুষ ও নারীর মধ্য থেকে যে-ই ভালো কাজ করলো, সে ঈমানদার হলে আমি তাকে একটি পবিত্র জীবনযাপন করার সুযোগ দিবো এবং তারা যে কাজ করছিল, আমি তাদেরকে তার উত্তম পারিশ্রমিক দান করবো। (সুরা নাহল: ৯৭)

জন্মগত পার্থক্য

উভয়ের জন্মগত যোগ্যতা, ক্ষমতা, দৈহিক গঠন ও দায়িত্বের দিক দিয়ে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রথম পার্থক্য হলো, মানবজীবনের দুটি অংশ, ঘর ও বাহির। নারী ঘরে, পুরুষ বাইরে। বাইরের যাবতীয় কষ্টকর ও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজ পুরুষের উপর অর্পিত। আর নারীর মৌলিক দায়িত্ব সন্তানের লালন-পালন ও ঘরোয়া পরিবেশকে সুসজ্জিত করা। সেইসাথে তার কোমল স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সহজ ও অপেক্ষাকৃত হালকা কাজও তারা করতে পারেন। কোনো কোনো অপরিহার্য সামাজিক প্রয়োজনে তারা ঘরের বাইরেও যেতে পারেন। যেমন: শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি। দ্বিতীয় পার্থক্য হলো, যেহেতু জন্মগতভাবে নারী আকর্ষণীয় ও কোমল স্বভাবের সেহেতু নারী ও পুরুষের স্বতন্ত্র অবস্থান ও কর্মক্ষেত্র অত্যাবশ্যক। নারীকে শালীন পোশাক ও পর্দার বিধান মেনে চলার হুকুম দেয়া হয়েছে। এটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। মহান আল্লাহ বলেন—

হে নবী, আপনি মুমিন মহিলাদের জানিয়ে দিন যে, ‘তারা যেন দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থান-সমূহের হেফাজত করে এবং তারা যেন তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে। তবে যা এমনি বের হয়ে যায়, সেটা ভিন্ন কথা’ (সুরা নুর: ৩১)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- ওহে নারী! তোমরা তোমাদের বাড়িতেই থাকবে, আর খবরদার! জাহেলী যুগের মেয়েদের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ (সুরা আহজাব: ৩৩)

জাহেলি যুগ ও আধুনিক যুগে নারী ও ইসলাম

সে যুগে নারী ছিল অবহেলিত, নির্যাতিত ও ভোগ্য পণ্যের মতো। ইসলাম নারীকে বানাল পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী। দিয়েছে সম্পদের অধিকার। পিতার সম্পদে, স্বামীর সম্পদে, সন্তানের সম্পদে। তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব হয় পিতার, অথবা স্বামীর, না হয় সন্তানের। কেউ না থাকলে রাষ্ট্রের। নারী অভিভাবকহীন নয়; জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতা নারীর ছিল না। ইসলাম বলল, না; তার মতামত ছাড়া হবে না। স্বামী গ্রহণে নারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। যদি সে ন্যায়ের ওপর থাকে।

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে জাহেলি যুগের নির্যাতিতা, অবহেলিতা নারী এসে বলার অধিকার পেলো, হে আল্লাহর রাসুল! আমার স্বামী আমার প্রাপ্য হক দেয়নি। বলতে পারলো নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা; ‘না, অমুক আমার পছন্দ নয়।’

নারীর ভরণ পোষণে যেমন তার অভিভাবক দায়িত্বশীল, যেন ভরণ পোষণের পিছে ছুটতে গিয়ে সে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় (যেমনটি ঘটে পশ্চিমা নারীর বেলায়, জীবিকা অর্জনে সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়), তেমনি নারী যাতে বৈবাহিক জীবনেও ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, এ ব্যাপারেও নারীর অভিভাবক দায়িত্বশীল। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে নিরাপত্তাহীন ছেড়ে দেয়নি ইসলাম। দিয়েছে মত প্রকাশের অধিকার। অভিভাবক যদি তার প্রতি অবিচার করে, তাও সে বলতে পারবে।

ইসলাম দিলো নারীর নিরাপত্তা

নারীর প্রতি চোখ তুলে তাকানোও নিষেধ। পুরুষকে দৃষ্টি অবনত রাখতে, আর লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে নির্দেশ দেওয়া হলো (সুরা নুর: ৩০)। নারীর বিপদ হবে, তাই হাদিসে বলা হলো, ‘কোনো পুরুষ যেন কোনো নারীর সঙ্গে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে’ (তিরমিজি : ১১৭১)। নারীর প্রতি সকল প্রকারের অন্যায়কে ঘোষণা করলো মহাপাপ, কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কিন্তু দুঃখজনক, আজকের ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সমাজে নারী মুক্তির মেকি শ্লোগানে পরোক্ষভাবে নারীর অধিকারে হস্তক্ষেপ বাড়ছে। নইলে নারীকে কেন হতে হয়; নতুন গাড়ির ‘মডেল’,পণ্যের অ্যাডে ‘নারীপণ্য’? অর্থের বিনিময়ে কেন কেনা যায় নারীর রূপ-যৌবন? নারীকে রক্ষা না করে, কেন তাকে ধোকা দেয়া হচ্ছে এই বলে, ‘তুমি যৌনকর্মী (সমস্য নাই, তুমি তো কর্ম করে খাচ্ছ)?

ওরা যদি সত্যিকার অর্থেই নারীর মর্যাদা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই চাইত, তাহলে ইসলামি মূল্যায়ন ও নির্দেশনাগুলোকেই তুলে ধরতো। কারণ, ইসলামের চেয়ে উত্তম কোনো মূল্যায়ন ও নির্দেশনা নেই।  ইসলাম নারীর দেন মোহর, মিরাস, মর্যাদা ও নিরাপত্তা ঠিক রেখে অর্থ উপার্জনের অধিকার দিয়েছে। (তার ওপর তো কারো ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেই)। এসব তারই নিরাপত্তার জন্য, মর্যাদা রক্ষার জন্য। 

মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন সভ্যতায় বলি হওয়া নারীকে উদ্ধার করে নিরাপত্তার চাঁদরে বেষ্টিত করেছে ইসলাম। সমাসীন করেছে মর্যাদার সুউচ্চ শিখরে। এমন যেন না হয়—সব শ্লোগান থেমে যাবে, আর নারী চোখ খুলে দেখবে- তার সবকিছু হারিয়ে গেছে। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে বোঝার তাওফিক দিন। আমিন।