images

ইসলাম

মহানবী (স.)-এর মহানুভবতার কিছু অনন্য উদাহরণ

ধর্ম ডেস্ক

১৩ অক্টোবর ২০২২, ০৪:১৫ পিএম

হজরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন মানবতার মূর্তপ্রতীক। ক্ষমা ও মহানুভবতার গুণে গুণান্বিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব তিনি। প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি চরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দিতেন।

মক্কা বিজয়ের দিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
মক্কা বিজয়ের দিনে রাসুল (স.) মক্কার লোকদের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘হে কোরাইশরা! তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা করো?’ তারা বলল, সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মতো! তিনি বললেন, ‘তোমরা চলে যাও! আজ তোমরা মুক্ত!’ শুধু তা-ই নয়, কাফের নেতা আবু সুফিয়ানের ঘরে যে ব্যক্তি আশ্রয় নেবে, তাকেও তিনি ক্ষমা করেন। 

তিনি ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ থাকবে।’ নবীজির (স.) এই অপূর্ব করুণা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত মক্কাবাসী অভিভূত হয়ে পড়ে। সজল নয়নে নির্বাক তাকিয়ে থাকে মহামানবের মুখের দিকে। এমনও কি হতে পারে? জীবনভর যাঁর সঙ্গে শত্রুতা করেছি, চিরতরে শেষ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছি, তিনিই আজ এই বদান্যতা, করুণা ও কোমলতা দেখালেন? তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নবীজি (স.)-এর চরণতলে নিজেদের সঁপে দেয়। তারা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকে—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃ. ৪০৫, ৪০১)

অনুসারীদেরকে দয়ার শিক্ষা
অমুসলিমরা তাঁকে পাগল ডাকত, আঘাত করত, কঠোর ভাষায় কথা বলত। অথচ নবীজি তাদের সঙ্গে এমন কোমল আচরণ করতেন, যা শুধু নিজ পরিবারের সঙ্গেই করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলছেন, ‘আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছেন..।’ (সুরা আলে ইমরান: ৩)

যারা একসময় তাঁকে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন, সামাজিকভাবে বয়কট করা এমনকি হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল, অথচ তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন! এভাবেই সহনশীলতা তাঁর চরিত্রকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনন্য উচ্চতায়। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (মুসলিম: ২৩১৯)

মসজিদ অপবিত্রকারী বেদুইনকে ক্ষমা
রাসুল (স.) একবার সাহাবিদের সঙ্গে মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুঈন এসে সেখানে পেশাব করা শুরু করলে সাহাবিরা তাকে ধমক দিয়ে থামতে বললেন। রাসুল (স.) বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও; বাধার সৃষ্টি করো না।’ তারপর তিনি লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘এটা মসজিদ, এ স্থান অপবিত্রতা কিংবা পেশাব পায়খানার জন্য উপযুক্ত নয়।’ অতঃপর রাসুল (স.) একজনকে বললেন, তুমি পানিভর্তি একটা বালতি নিয়ে আসো। এরপর এর ওপর ঢেলে দাও। তিনি বালতিতে পানি এনে তার ওপর ঢেলে দিলেন। (মুসনাদে আহমদ: ১২৯৮৪)

পেশাব আটকে রাখলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে, এই চিন্তা থেকে রাসুল (স.) লোকটিকে পেশাবের মাঝে বাঁধা দিতে নিষেধ করেন এবং মসজিদে পেশাব করার সাময়িক অনুমতি দেন। যারা উগ্র মানসিকতা সম্পন্ন, তাদের জন্য এটি একটি শিক্ষণীয় ঘটনা। ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের সঙ্গে ইসলাম কী ধরনের ব্যবহার করতে বলেছে, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে বিদ্যমান। 

ইহুদির লাশের সামনেও দাঁড়িয়ে যেতেন
মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবেই সম্মান করতেন। সম্মান করার শিক্ষা দিতেন। তাঁর মনে অমুসলিমদের প্রতি কোনো ঘৃণা ছিল না। এমনকি কোনো ইহুদির লাশ দেখলেও সম্মান প্রদর্শনে দাঁড়িয়ে যেতেন। একবার নবীজির পাশ দিয়ে এক ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি তা দেখে দাঁড়ালেন। উপস্থিত সাহাবারা বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। নবীজি তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলাইসাত নাফসা? অর্থাৎ, সেকি মানুষ নয়?’ (বুখারি: ১৩১২)

যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ
যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতেন নবীজি। প্রিয়নবী (স.)-এর সমরনীতিতে অনর্থক রক্তক্ষয়ের উন্মাদনা ছিল না। তাই অল্প লোকক্ষয় ও সীমিত সময়ে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হত। যুদ্ধে যেসব অমুসলিম নিহত হতো, তাদের লাশ যেন বিকলাঙ্গ না করা হয়, সে ব্যাপারে নবীজি ছিলেন সদা তৎপর। আর যারা বন্দি হতো, তাদের সঙ্গেও করতেন কোমল ও সম্মানপূর্বক আচরণ। 

যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যেন কোনো অমানবিক আচরণ না ঘটে, সেজন্য সাহাবিদের কঠোর নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যে মুসলিম তার বন্দির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ: ৩২)

তায়েফবাসীর জন্য দোয়া
নবীজিকে হত্যা করার জন্য অমুসলিমরা কত ষড়যন্ত্রই না করেছিল। লেলিয়ে দিয়েছিল দুষ্টু বালকদের। যার পবিত্র শরীরে মশা-মাছি বসাকে হারাম করা হয়েছে, সেই নবীজির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তায়েফের জমিন। ওহুদের ময়দানে হারাতে হয়েছে পবিত্র দাঁত। তারপরও তিনি তাদের জন্য বদদোয়া করেননি। 

বরং সাহাবারা যখন রাসুল (স.) এর কাছে আবেদন জানাতেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।’ তখন নবীজি রক্তাক্ত চেহারা মুছতে মুছতে বলতেন, ‘আমি অভিশাপ দেওয়ার জন্য আসিনি, বরং আমি এসেছি ক্ষমা প্রার্থনার জন্য।’ এরপর তিনি দোয়া করতেন, ‘হে আমার মালিক! আমার লোকদের ক্ষমা করুন। তারা জানে না যে, তারা কী করছে।’ (মুসলিম: ২৫৯৯, ইবনে হিব্বান: ৯৮৫)

অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার নির্দেশ
অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় নবীজি কঠিন নির্দেশ দিতেন। কোনো গর্হিত কাজ না করার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি করে বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষালম্বন করব।’ (মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার: ৫৭৫০)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবীজির (স.) জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।