images

ইসলাম

বানর কি বনি ইসরাইলের বিকৃত মানুষগুলোরই বংশধর?

ধর্ম ডেস্ক

১৩ অক্টোবর ২০২২, ১১:৪১ এএম

আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকূলের মধ্যে বানরও একটি। অনেকের মধ্যে একটি ভুলবিশ্বাস থাকতে পারে যে, বানর জাতি বনি ইসরাইলের সেই বিকৃত মানুষগুলোরই বংশধর। এই ধারণা ঠিক নয়। ঘটনাটি ছিল এমন—বনী ইসরাইলের জন্য শনিবারে মাছ শিকার করা নিষেধ ছিল। তারা সমুদ্র-উপকূলের অধিবাসী হওয়াতে মাছ শিকার করা ছিল তাদের প্রিয় কাজ। এদিকে অন্যান্য দিনের তুলনায় শনিবারে সমুদ্রকূলে মাছ আসত বেশি। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তারা মাছ শিকার করতে থাকে। এতে আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন এবং বানর ও শুকরে রূপান্তর করে তাদেরকে আজাব দেন। 

তাদের বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তাদের কাছে সে জনপদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো, যা ছিল নদীর তীরে অবস্থিত। যখন শনিবার দিনের নির্দেশের ব্যাপারে সীমা অতিক্রম করতে লাগল, যখন আসতে লাগল মাছগুলো তাদের কাছে শনিবার দিন পানির ওপর, আর যেদিন শনিবার হতো না, আসত না। এভাবে আমি তাদের পরীক্ষা করেছি। কারণ, তারা ছিল নাফরমান।’ (সুরা আরাফ: ১৬৩)

তাফসির ও ইতিহাস গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.)-এর সময়ে একটি জনপদের অবস্থান ছিল সমুদ্র উপকূলের দিকে। পুরো সপ্তাহ তারা মাছ শিকার করত আর তাদের জন্য শনিবার ছিল ইবাদতের দিন। সেদিন দাউদ (আ.) আসমানি কিতাব জাবুর পাঠ করতেন। অনেক সৃষ্টিজীব মুগ্ধ হয়ে তার জাবুর পাঠ শুনত।

এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, আল্লাহ তাআলা হজরত দাউদ (আ.)-কে বীরত্ব, সাহসিকতা, খেলাফত, বিচারিক দক্ষতা, পশুপাখির ভাষা বোঝার ক্ষমতা ছাড়াও আরেকটি অনন্য গুণ দিয়েছিলেন। সেটি হলো সুরলহরী। তাঁর মতো সুমধুর কণ্ঠস্বর আর কাউকে দেওয়া হয়নি। কেয়ামতের দিন হজরত দাউদ (আ.) আরশে আজিমের স্তম্ভের কাছে দণ্ডায়মান থাকবেন। তখন তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হবে মধুর সুরে আল্লাহর প্রশংসা ও মহত্ত্ব প্রকাশ করতে। সেদিন দাউদ (আ.)-এর সুরে জান্নাতবাসীরা মুগ্ধ হবেন।’ (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা-৬১৮)

তিনি যখন কিতাব পড়তেন, আকাশের পাখি ও বনের পশু তাঁর চারপাশে জড়ো হতো। শুধু তাই নয়; নদীর পানির প্রবাহ পর্যন্ত থেমে যেত তাঁর সুরে।’ ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ বলেছেন, ‘দাউদ (আ.)-এর কণ্ঠস্বর যে-ই শুনত, সে–ই লাফিয়ে উঠত এবং সুরের তালে তালে যেন নাচতে শুরু করত। তিনি এমনভাবে যাবুর পাঠ করতেন, যা কোনো দিন আর কেউ শোনেনি। তাঁর যাবুর পাঠের সুর শুনে জিন-ইনসান, পশুপাখি জীবজন্তু স্ব-স্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে যেত। (আল্লামা ইবনে কাসির, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা-৬১৫)

সেদিন সমুদ্রতীরে অনেক বেশি মাছও আসত। যেহেতু একটি পবিত্র উদ্দেশ্যে এসব প্রাণী একত্র হতো, তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে দাউদ (আ.) সেদিন মাছ শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু দুষ্টুলোকেরা একটি ফন্দি আঁটল। তারা শনিবারে জাল পেতে মাছ আটকিয়ে রাখত। রোববারে সেই মাছগুলো ধরে নিয়ে আসত। এভাবে তারা আল্লাহ ও তাঁর নবীর ফরমান অমান্য করত। তাদেরকে শনিবারে মাছ ধরার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলত- কই আমরা তো শনিবারে নয়, রোববারে মাছ ধরেছি। অবশেষে ঈমানদাররা অপারগ হয়ে সেসব কৌশলী লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন এবং তাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যান। তারা গ্রামের মাঝখানে একটি দেয়াল তৈরি করে দেন। সৎ লোকেরা একটি দরজা দিয়ে যাতায়াত করতেন আর অসাধু লোকেরা অন্য দরজা দিয়ে যাতায়াত করত।

এভাবে অনেক দিন অতিবাহিত হয়। এক দিন হঠাৎ এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। রাত শেষে ভোর পেরিয়ে বেলা বেড়ে গেলেও সেই অসাধু লোকদের ঘরের দরজা খুলছে না। ভেতর থেকেও তাদের কোনো সাড়া-শব্দ নেই। অনেক্ষণ কেটে যাওয়ার পর খোঁজ নিতে গেলে এক বিস্ময়কর চিত্র দেখা যায়। দেখা যায়- সেসব পরিবারের সব নারী-পুরুষ-শিশু বানরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। তাদের লেজও গজিয়েছে। তাদের সবাইকে চেনা যাচ্ছিল, সে অমুক  পুরুষ, সে অমুক নারী এবং এ অমুক শিশু ইত্যাদি। (তাফসিরে কুরতুবি: ১/৪৭৯; তাফসিরে তাবারি: ২/১৬৭, ১৩/৮০-৮১)

এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তো তাদের ভালোভাবে জানো, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও। অতঃপর আমি এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ হিসেবে রেখে দিলাম।’ (সুরা বাকারা: ৬৫-৬৬)। 

এ থেকে কারো কারো মনে এমন ধারণা জন্মেছে যে, বানর জাতি সেই বিকৃত বনি ইসরাইলেরই বংশধর। কিন্তু তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। মানুষ ও বানর আল্লাহ তাআলার ভিন্ন দুটি সৃষ্টি। বানর মানুষ ছিল না এবং মানুষও কখনও বানর ছিল না। এরা সম্পূর্ণ পৃথক দুটি প্রজাতি। রূপান্তরিত বানর পৃথিবীতে বংশবিস্তার করেনি। সেই অবস্থাতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। 

সুতরাং বানর বিকৃত ও রূপান্তরিত কোনো প্রজাতি নয়। সহিহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের যুগের বানর ও শুকরগুলো কি সেই রূপান্তরিত সম্প্রদায়? নবীজি উত্তরে বললেন, আল্লাহ তাআলা যখন কোনো সম্প্রদায়ের আকৃতি রূপান্তরিত করেন তখন তাদের বংশ বিস্তার হয় না। অর্থাৎ তারা রূপান্তরিত অবস্থায়ই ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি আরও বললেন, বানর ও শুকর তো পৃথিবীতে আগেও ছিল। (সহিহ মুসলিম: ২৬৬৩)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের কোনো বংশ বৃদ্ধি হয়নি।’ (ইবনে হাতিম: ১/২০৯)

বানরে রূপান্তরিত অভিশপ্ত সেই মানুষগুলো নাক ঘষতে ঘষতে সবাই মারা যায় এবং তাদের বংশ বৃদ্ধি বিদায় নেয়। আর যে বানরগুলো এখন আছে এবং তখনও ছিল, এরা অন্যান্য প্রাণীদের মতোই ভিন্ন একটি প্রজাতি। এরা স্বাভাবিকভাবেই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। এর সঙ্গে বনি ইসরাইলের সেই অভিশপ্ত জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই।