ধর্ম ডেস্ক
০৬ অক্টোবর ২০২২, ০৭:২০ পিএম
আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল আরওয়া বা আওরা। উপনাম উম্মে জামিল বা সুন্দরের উৎস। সম্পর্কে সে আবু সুফিয়ানের বোন। একচোখ দৃষ্টিহীন হওয়ায় ইবনুল আরাবি এই মহিলাকে ‘আওরা উম্মে ক্বাবিহ’ ‘এক চক্ষু সকল নষ্টের মূল’ বলে অভিহিত করেন’।(তাফসিরে কুরতুবি)
স্বামীর অকপট সহযোগী ছিল সে। আবু লাহাব ছিল রাসুলুল্লাহর (স.) নিকটতম প্রতিবেশী। উভয়ের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর। ওরা বাড়িতেও রাসুলুল্লাহ (স.)-কে নিশ্চিন্তে থাকতে দিত না। তিনি যখন নামাজ পড়তেন, এরা তখন ওপর থেকে ছাগলের নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপ করত। কখনো তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্না হত, ওরা তখন হাড়ির মধ্যে ময়লা ছুঁড়ে দিত। নবীজি (স.) বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন, ‘হে বনী আবদে মান্নাফ! এ কেমন প্রতিবেশীসূলভ আচরণ?’ আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল নবী (স.)-এর ঘরের দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডালপালা ছড়িয়ে রেখে দিত। এটা ছিল তার প্রতি রাতের স্থায়ী আচরণ। যাতে রাসুলুল্লাহ (স.) বা তাঁর শিশু সন্তানেরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিঁধে যায়। (বায়হাকি; ইবনে আবি হাতেম; ইবনে জারির; ইবনে আসাকির ও ইবনে হিশাম)
নবীজির বিরুদ্ধে গিবত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকত আবু লাহাবের স্ত্রী। চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায় ইন্ধন বহনকারী বা ‘খড়িবাহক’ বলা হত। অর্থাৎ ওই শুষ্ককাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করত পেছন থেকে। সেকারণে আল্লাহ তাআলা তাকেও স্বামীর সঙ্গে জাহান্নামে পাঠাবেন বলে সুরা নাজিল করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত এবং সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ এবং যা সে অর্জন করেছে তা তার কোনো কাজে আসবে না। অচিরেই সে নিমজ্জিত হবে লেলিহান আগুনে। এবং তার স্ত্রীও; যে ইন্ধন বহনকারিণী। তার গলদেশে খেজুর আঁশের পাকানো রশি।’ (সুরা লাহাব: ১-৫)
এই সুরা নাজিল হওয়ার পর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওই মহিলা হাতে প্রস্তরখণ্ড নিয়ে মহানবী (স.)-কে মারার উদ্দেশ্যে কাবা চত্বরে গমন করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসুল (স.) সামনে থাকা সত্ত্বেও সে তাঁকে দেখতে পায়নি। (মুসনাদে বাজজার: ১৫; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১১৫২৯)
নবীজিকে না পেয়ে পাশে দাঁড়ানো আবুবকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসাপূর্ণ কবিতা বলে ফিরে আসে সে। কবিতায় সে ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেছিল। যেমন- ‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’। (ইবনে হিশাম: ১/৩৫৬; হাকেম: ৩৩৭৬, ২/৩৬১; তাফসির কুরতুবি, ইবনে কাসির; সিরাহ সহিহাহ: ১/১৪৭)
ইমাম কুরতুবি (রহ.) সাঈদ ইবনে জুবায়ের থেকে বর্ণনা করেন, কোরআনে যখন সুরা লাহাব অবতীর্ণ হয়, সেখানে আবু লাহাবের স্ত্রীর নিন্দা করা হয়। এ কথা শুনে তার স্ত্রী রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মজলিসে উপস্থিত হয়। ওই মজলিসে আবু বকর (রা.) বিদ্যমান ছিলেন। ওই নারীকে দূর থেকে আসতে দেখে আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলেন, আপনি এখান থেকে সরে গেলে ভালো হয়। কেননা সে অত্যন্ত কটূভাষিণী। সে এমন কথা বলবে, যা বহু মানুষ মুখেও উচ্চারণ করতে পারে না। ফলে আপনি কষ্ট পাবেন। মহানবী (স.) বলেন, আমার যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। মহান আল্লাহ তার ও আমার মধ্যে পর্দা ফেলে দেবেন। অতঃপর ওই নারী মজলিসে উপস্থিত হয়, কিন্তু সে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে দেখতে পায়নি। সে আবু বকর (রা.)-কে সম্বোধন করে বলতে লাগল, আপনার সঙ্গী আমাকে ‘হিজু’ (কবিতার মাধ্যমে নিন্দা) করেছে। আবু বকর (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম, তিনি তো কবিতা বলেন না। তিনি কবিতা জানেন না। অতঃপর সে এ কথা বলতে বলতে প্রস্থান করে যে আপনিও তো তাকে সত্য বলে বিশ্বাসকারীদের অন্যতম। এ কথা বলে ওই নারী চলে যায়। চলে যাওয়ার পর আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলেন, সে কি আপনাকে দেখেনি? তিনি বলেন, না। যতক্ষণ সে এখানে ছিল, ততক্ষণ একজন ফেরেশতা আমাকে তার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছিল। এটা ছিল রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মোজেজা। (তাফসিরে কুরতুবি)
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে মুহাম্মদ) আপনি যখন কোরআন পাঠ করেন, তখন আপনার ও পরকালে অবিশ্বাসীদের মধ্যে আমি (আল্লাহ) এক প্রচ্ছন্ন পর্দা রেখে দিই। (সুরা বনি ইসরাঈল: ৪৫)