ধর্ম ডেস্ক
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:৪২ পিএম
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ছেলে হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত কূপ জমজম। এটি মসজিদে হারামের কাছে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ কূপ। হজ ও ওমরা আদায়কারীর জন্য বিশেষভাবে এবং পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য সাধারণভাবে জমজমের পানি পান করা মোস্তাহাব। নবীজি (স.) নিজে জমজম থেকে পানি পান করেছেন। (সহিহ বুখারি: ১৫৫৬)। হজরত আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (স.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি বরকতময়, স্বাদ অন্বেষণকারীর খাদ্য।’ (সহিহ মুসলিম: ২৪৭৩)
ফকিহগণ জমজমের পানি পানের কিছু আদব উল্লেখ করেছেন, যেমন—কেবলামুখী হওয়া, বিসমিল্লাহ বলা, তিন শ্বাসে পান করা, পরিতৃপ্ত হওয়া, শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা ইত্যাদি। জমজমের পানি ইবাদত মনে করে পান করা উচিত। জমজমের পানি পান করার সময় বড় কাজটি হলো—নেক নিয়ত ও দোয়া করা। জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩০৬২)
আরও পড়ুন: জমজম কূপ: আল্লাহর এক বিস্ময়কর নিদর্শন
পূর্বসূরি মনীষীদের জীবনীতে দেখা যায়—তাঁরা জমজমের পানি পানের সময় সুন্দর নিয়ত ও বিভিন্ন দোয়া করতেন। এখানে কয়েকজন মনীষীর উদ্ধৃতি দেওয়া হলো—
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জমজমের পানি পান করেছিলাম স্মৃতিশক্তিতে হাফিজ শামসুদ্দিন জাহাবি (রহ.)-এর স্তরে পৌঁছার নিয়তে। সুয়ুতি বলেন, ইবনে হাজার ওই স্তরে পৌঁছেছিলেন; বরং তাঁর স্মৃতিশক্তি আরো অধিক প্রখর হয়েছিল। (তাবাকাতুল হুফফাজ: ১/৫২২)
আরও পড়ুন: ‘মাকামে ইবরাহিম’ আল্লাহর কুদরতের অনন্য নিদর্শন
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, আমার হাদিস শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে একবার আমি জমজমের পানি পান করলাম এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম যে, তিনি যেন আমাকে হাদিস মুখস্থ করার ক্ষেত্রে হাফিজ জাহাবি (রহ.)-এর অবস্থা দান করেন। তারপর যখন আমি ২০ বছর পর আবার জমজমের পানি পান করলাম এবং ওই স্তর থেকে বেশি কিছুর জন্য প্রার্থনা করতে মন চাইল, তখন আমি আরো উঁচু স্তরের জন্য দোয়া করলাম। আমি আশাবাদী যে, আল্লাহ তা-ও আমাকে দান করবেন। (মাওয়াহিবুল জালিল: ৩/১১৬)
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) জমজমের পানি পান করেন এই নিয়তে যে, আল্লাহ তাআলা যেন তাঁকে ফিকহশাস্ত্রে ইমাম সিরাজুদ্দিন আল বুলকিনি (রহ.)-এর স্তরে এবং হাদিসশাস্ত্রে হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)-এর স্তরে পৌঁছে দেন।
প্রসিদ্ধ মুফাসসির আল্লামা ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন, ৪৮৯ হিজরির জিলহজ মাসে আমি মক্কায় অবস্থান করছিলাম। আমি খুব বেশি করে জমজমের পানি পান করতাম। প্রতিবার পানের সময় আমি ইলম ও ঈমানের নিয়ত করতাম। ফলে আল্লাহ তাআলা এর বরকত আমাকে দান করেন এবং আমি যথাসাধ্য ইলম হাসিল করলাম। কিন্তু আমলের নিয়তে জমজমের পানি পান করতে ভুলে গেলাম। হায়! যদি আমলের নিয়তেও পান করতাম, তবে আল্লাহ আমাকে ইলম ও আমল উভয়টির বরকত নসিব করতেন। কিন্তু তা হলো না। (আহকামুল কোরআন: ৩/৯৮)
আরও পড়ুন: হাজরে আসওয়াদের ঐতিহাসিক তথ্য
আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাফর বলেন, হাদিসশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে খুজায়মা (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, এত ইলম আপনি কিভাবে অর্জন করলেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘জমজমের পানি যে নিয়তে পান করা হয় তা-ই কবুল হয়। ’ আর আমি যখন জমজমের পানি পান করেছিলাম, তখন আল্লাহর কাছে উপকারী ইলম প্রার্থনা করেছিলাম। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১৪/৩৭০)
শায়খ ইয়াহইয়া ইবনে আহমদ আল আনসারি (রহ.) কোরআন হিফজের নিয়তে জমজমের পানি পান করেন। ফলে তিনি খুবই স্বল্প মেয়াদে কোরআন হিফজ করতে সক্ষম হন।
হাকিম আবু আবদুল্লাহ (রহ.) জমজমের পানি পান করেন উৎকৃষ্ট রচনা সংকলনের নিয়তে। ফলে তিনি ছিলেন স্বীয় যুগের সবচেয়ে ভালো মানের লেখক ও সংকলক। (ফাতহুল কাদির: ২/৩৯৮-৪০০)
বড় উদ্দেশ্য সামনে রেখেও জমজমের পানি পান করতেন আলেমরা। যেমন—হাফিজ ইবনে হাজার (রহ.) বর্ণনা করেন, ইমাম শাফেয়ি (রহ.) তীর নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জনের নিয়তে জমজমের পানি পান করেন। ফলে প্রতি ১০টি তীরের ৯টিই তিনি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দিতে পারতেন। (ফায়জুল কাদির: ২/৫০৭)
হাফিজ সাখাওয়ি (রহ.) ইবনুল জাজারি (রহ.)-এর জীবনালোচনায় লেখেন, তাঁর পিতা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ৪০ বছর পর্যন্ত কোনো সন্তান লাভ করেননি। এরপর তিনি হজে গেলেন এবং পুণ্যবান সন্তান পাওয়ার নিয়তে জমজমের পানি পান করলেন। পরে এক রাতে সালাতুত তারাবির পর মুহাম্মদ আল জাজারির জন্ম হয়। আর জ্ঞান-গরিমায়, বিশেষত কিরাতশাস্ত্রে ইবনুল জাজারি (রহ.)-এর যে শীর্ষ অবস্থান ছিল, তা তো বিজ্ঞজনের জানাই আছে। (আল গায়াহ: ১/৫৮)
আরও পড়ুন: যে কারণে হজযাত্রীদের টানে নবীজির মদিনা শহর
কোনো কোনো আলেমের ব্যাপারে বর্ণনা পাওয়া যায় যে যখন তিনি জমজমের পানি পান করেন, দোয়া করেন, ইয়া আল্লাহ! আপনার নবী আমাদের বলে গেছেন—‘জমজমের পানি যে নিয়তে পান করা হয় তা-ই কবুল হয়। ’ ইয়া আল্লাহ! আমি এই জমজমের পানি পান করছি, যেন কেয়ামত দিবসে তৃষ্ণার্ত না হই। (আখবারু মক্কা: ২/৩২)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র জমজমের পানি নেক নিয়তে পান করার তাওফিক দান করুন। ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত জমজমের বরকত মুসলিম উম্মাহকে দান করুন। আমিন।