আজিম বাপ্পি
০১ মার্চ ২০২২, ০৫:৫০ পিএম
মসজিদ আল্লাহর ঘর। শান্তি ও কল্যাণের ঘর। মানবতার ইহ ও পরকালীন মুক্তি এবং সামগ্রিক কল্যাণের কেন্দ্রবিন্দু। ইবাদতের জায়গা। যেখানে মহান রবের সৃষ্টির শুকরিয়া জানিয়ে দিনে পাঁচবার সিজদায় অবনত হন মুসলমানরা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ-জনপদে রয়েছে পবিত্র এই ঘর। তার মধ্যে অন্যতম তুরস্কের ইস্তাম্বুল এবং ঢাকা।
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। এই শহরের অলি-গলিতে ছড়িয়ে আছে মসজিদ।
মুঘল আমল থেকে ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে মসজিদ নির্মাণ বাড়তে থাকে ঢাকায়। ‘মসজিদের শহর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে সংখ্যাধিক্যের দিক থেকে। মূলত মুঘল আমল থেকেই মসজিদের নগরীতে পরিণত হয় শহরটি।
১৮৩২ সালে ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট জর্জ হেনরি ওয়াল্টার এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন, সেসময় ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা ছিল ১৫৩টি। যার সংখ্যা ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকে। ১৯ শতকে কিছুটা কমে যায় মসজিদ নির্মাণ। তবে পাকিস্তান আমলে নতুন মোড় নেয় মসজিদগুলোর নির্মাণশৈলী। পরবর্তীতে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতার কারণে শুরু হয় আরও বেশি মসজিদ নির্মাণ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় বর্তমানে মসজিদ রয়েছে ১০ হাজার।
ঢাকার বিখ্যাত যত মসজিদ
জেনে নিন ঢাকার বিখ্যাত কয়েকটি মসজিদ সম্পর্কে।
বিনত বিবির মসজিদ
মধ্যযুগীয় এই মসজিদের অবস্থান পুরান ঢাকার নারিন্দায়। দেখে বোঝার উপায় না থাকলেও ঢাকার প্রথম মসজিদ এটি। মুঘল সেনাপতি ইসলাম খানের ঢাকা আগমনের প্রায় ১৫০ বছর আগে বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মসজিদটি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদাসীনতায় হারিয়ে যেতে বসেছে মসজিদটির আদল ও কাঠামো। বদলে ফেলা হচ্ছে ঐতিহ্য।
মুসা খাঁর মসজিদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহ হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থান মুসা খাঁর মসজিদের। সে সময় শহীদুল্লাহ হল এলাকা পরিচিত ছিল বাগ-ই-মুসা খাঁ, অর্থাৎ মুসা খাঁর বাগান নামে। তিনি ছিলেন বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈসা খাঁর ছেলে। মসজিদের পাশেই রয়েছে তার মাজার। তবে অনেকে মনে করেন, মসজিদটি মুসা খাঁর আমলে তৈরি হয়নি। স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী তারা ধারণা করছেন, এটি শায়েস্তা খাঁর আমলে নির্মিত। তাদের মতে, মসজিদটি নির্মাণ করেছেন মুসা খাঁর ছেলে দিওয়ান মুনওয়ার খান। আনুমানিক ১৬৭৯ সালের দিকে তিনি এটি নির্মাণ করেন।
চকবাজার শাহী মসজিদ
চকবাজার শাহী মসজিদটি অবস্থিত পুরান ঢাকার চকবাজারে। ১৬৭৬ সালে মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খান নির্মাণ করেন এটি। তিনটি গম্বুজ আর সুবিশাল মিনারই এর মূল আকর্ষণ।
কর্তালাব খান মসজিদ
কর্তালাব খান মসজিদ। অবস্থান পুরান ঢাকার বেগম বাজারে। বেগম বাজার মসজিদ নামেও পরিচিত এটি। ধারণা করা হয়, ১৭০১ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যেই নির্মিত এটি। তৎকালীন দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খানের নামে করা হয় মসজিদটি। আর মুর্শিদ কুলি খানই পরিচিত কর্তালাব খান নামে।
তারা মসজিদ
মুঘল স্থাপত্যশিল্পের ঐতিহ্যকে ধারণ করে পুরান ঢাকায় নির্মাণ করা হয় তারা মসজিদ। ১৭ শতকে দিল্লি, আগরা এবং লাহোরে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনার আদলেই নির্মাণ করা হয় এটি। এই মসজিদের অবস্থান পুরান ঢাকার আরমানিটোলায়। ১৯২৬ সালে ঢাকার ব্যবসায়ী আলী জান ব্যাপারী সংস্কার করেন মসজিদটি।
হাজী শাহবাজ মসজিদ
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত প্রাচীন মসজিদ। মুঘল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। হাজী শাহবাজ নামে একজন অভিজাত ধনী ব্যবসায়ী এটি নির্মাণ করেন।
লালবাগ শাহী মসজিদ
ঢাকার লালবাগ কেল্লার পাশে অবস্থিত প্রাচীন মসজিদ। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ঢাকার উপ-শাসক সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফররুখশিয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি নির্মিত হয়।
খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ
লালবাগ কেল্লার আধা কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ। ১৭০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মসজিদটি। সেখানে পাওয়া ফার্সি অনুলিপি অনুযায়ী খান মোহাম্মদ মৃধা নামক জনৈক ব্যক্তি নির্মাণ করেছিলেন মসজিদটি।
কসাইটুলি মসজিদ
পুরান ঢাকার কসাইটুলির কে পি ঘোষ রোডের এ মসজিদ ‘কাস্বাবটুলি জামে মসজিদ’ নামে পরিচিত। এর আরেক নাম ‘চিনির টুকরা মসজিদ’। হিজরি ১৩৩৮ সনে জনৈক ব্যবসায়ী আবদুল বারি এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
ঢাকায় সর্বপ্রথম বিপুল ধারণক্ষমতার একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার চিন্তা করেন তৎকালীন পাকিস্তানের আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি। সে অনুযায়ী ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পুরাণ ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য ৮ দশমিক ৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল নিকটবর্তী। সে সময় মসজিদের অবস্থানে একটি বড় পুকুর ছিল। যা ‘পল্টন পুকুর’ নামে পরিচিত ছিল। পুকুরটি ভরাট করে ২৭ জানুয়ারি, ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান মসজিদটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ১৯৬৮ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।
এ মসজিদ কমপ্লেক্সের নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয় সিন্ধুর বিশিষ্ট স্থপতি আব্দুল হুসেন থারিয়ানিকে। পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, গ্রন্থাগার ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি (শুক্রবার) প্রথমবারের মতো এখানে নামাজ পড়া হয়।
১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। বর্তমানে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদটি আটতলা। নিচতলায় রয়েছে বিপণিবিতান ও একটি বৃহত্তর অত্যাধুনিক সুসজ্জিত মার্কেট কমপ্লেক্স। দোতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় নামাজ পড়া হয়।
২০০৮ সালে সৌদি সরকারের অর্থায়নে মসজিদটি সম্প্রসারিত করা হয়।পূর্বে ৩০হাজার মুসল্লি একত্রে নামায পড়লেও বর্তমানে এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ মসজিদের শোভাবর্ধন এবং উন্নয়নের কাজ এখনও অব্যাহত রয়েছে।
এজেড