ধর্ম ডেস্ক
২২ আগস্ট ২০২২, ১২:২৫ পিএম
হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর একজন প্রখ্যাত সাহাবি। মক্কার কুরাইশ বংশের ‘বনু আসাআদ’ শাখার সন্তান এবং উম্মুল মুমিনিন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা.)-এর ভাতিজা। পবিত্র কাবার অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণ করা ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি তিনি।
একবার তাঁর মা কুরাইশি বান্ধবীদের সঙ্গে কাবা শরিফের ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানেই তাঁর প্রসব বেদনা শুরু হয়। বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই সেখানেই একটি চামড়া বিছিয়ে দেওয়া হয়। তাতেই তিনি হাকিমকে প্রসব করেন। এটা হস্তী বাহিনীর ১৩ বছর আগের ঘটনা। তিনি রাসুল (স.)-এর চেয়ে ১৩ বছরের বড় ছিলেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৬; আনসাবুল আশরাফ: ৯/৪৫৪)
হাকিম (রা.) মক্কার এক সম্পদশালী অভিজাত পরিবারে বেড়ে ওঠেন। ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন ভদ্র ও বুদ্ধিমান, যার কারণে কুরাইশরা তাঁকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। জাহেলি যুগে তিনি মক্কায় আগত হাজিদের দেখাশোনা, আহার করানোর দায়িত্বে থাকতেন । এজন্য তাকে আরবি পরিভাষায় মুতয়িম বলা হয়। (সিরাতু ইবনে হিশাম: ১/৬৬৪-৬৫)
আরও পড়ুন: পবিত্র কাবাঘরের ইতিহাস
৬১৯ সালে রাসুল (স.) ও বনু হাশিমের সবাইকে যখন মক্কার উপত্যকা শিবে আবি তালিব উপত্যকাতে অবরুদ্ধ করা হয়, তখন হাকিম ইবনে হিজাম ইসলাম গ্রহণ না করলেও গোপনে বিভিন্ন বিপদ এড়িয়ে তাঁর ফুফু খাদিজাকে খাদ্য সামগ্রী পাঠাতেন। (সিরাতু ইবনে হিশাম: ১/৩৫৩-৩৫৪)
৬২৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় ইসলামের প্রথম ও প্রধান যুদ্ধ বদর। ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধের আগে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কুরাইশদের একটি বৈঠক দারুন নাদওয়ায় অনুষ্ঠিত হয়, সেই বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন হাকিম। (সিরাতু ইবনে হিশাম: ১/৪৮০-৮১)
হাকিম ইবনে হিজাম আবু জাহেলকে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, উতবাহ ইবনে রাবিআহও যুদ্ধ এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু আবু জেহেলের চাপের কারণেই যুদ্ধ সংগঠিত হয়। (সিরাতু ইবনে হিশাম: (১/৬২২-২৪)
আরও পড়ুন: ‘মাকামে ইবরাহিম’ আল্লাহর কুদরতের অনন্য নিদর্শন
অষ্টম হিজরি সনে মক্কা বিজয়ের সময় হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) তাঁর সব সন্তানসহ ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ৭৪ বছর। তিনি এত দেরিতে ইসলাম গ্রহণের জন্য সবসময় আফসোস করতেন ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতেন। মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল (স.) হাকিম ইবনে হিজামের ঘরকেও আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ করেছিলেন, ‘যে আবু সুফিয়ান, হাকিম ইবনে হিজাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকার ঘরে প্রবেশ করবে, সে মুসলিম বাহিনীর হামলা থেকে নিরাপদে থাকবে; এমনকি যে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে, সেও নিরাপদ।’ এরপর হাকিম (রা.) হুনাইন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাসুল (স.) তাঁকে ‘মুআল্লাফাতুল কুলুব’-এর অন্তর্ভুক্ত করে হুনাইনের গনিমত থেকে ১০০ উট দেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৪—৪৫, ৪৮; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/৬৮)
হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর ১০০ গোলাম আজাদ করেছিলেন, ১০০ উট বাইতুল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৯)
‘দারুন নাদওয়া’ মক্কার একটি বাড়ির নাম, যাতে কুরাইশ নেতারা একত্র হতো এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করত। বাড়িটি একসময় নির্মাণ করেছিল কুরাইশ বংশের ঊর্ধ্বতন পুরুষ কুসাই। কালক্রমে হাত বদল হয়ে বাড়িটির মালিক হন হাকিম ইবনে হিজাম (রা.)। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তা মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে এক লাখ দিরহাম মূল্যে বিক্রি করে দেন।
মুয়াবিয়া (রা.) তাঁকে তিরস্কার করে বললেন, ‘আরে আপনি আপনার বাপ-দাদার মর্যাদার স্মৃতিটুকুও বিক্রি করে দিলেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘জাহেলি যুগের সব মর্যাদার বিলুপ্তি ঘটেছে। একমাত্র তাকওয়া ও আল্লাহভীতির মাধ্যমে অর্জিত মর্যাদাই প্রকৃত মর্যাদা। তার বিলুপ্তি হবে না কখনো। এই বাড়িটি আমি খরিদ করেছিলাম এক ড্রাম মদের বিনিময়ে, আর এখন তা বিক্রি করলাম এক লাখ দিরহামে। আপনারা সাক্ষী থাকুন! এর সব দিরহাম আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা হবে।’ (মুজামুল বুলদান: ২/৪২৩; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/৬৯)
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি একাধিক হজ করেছেন। এক হজে ১০০ উট, আরেক হজে এক হাজার ছাগল কোরবানি করেন। আরেক হজে আরাফার ময়দানে ১০০ গোলাম আজাদ করেন। কোনো বর্ণনামতে, এক হজেই এসব করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/৬৯)