ধর্ম ডেস্ক
৩১ জুলাই ২০২২, ০৮:১৬ পিএম
মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ। মিথ্যাবাদিতা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মিথ্যাবাদীর শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা বাকারা: ১০)
মিথ্যুক আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। পবিত্র কোরআনে মুবাহালাসংক্রান্ত আয়াতে এসেছে, ‘অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহর কাছে) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে মিথ্যুকদের ওপর আল্লাহর লানত পতিত হোক’ (সুরা আলে ইমরান: ৬১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘(অনুমানভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক।’ (সুরা জারিয়াত: ১০)
মিথ্যা বলতে থাকলে একসময় চরম মিথ্যুকের তালিকায় নাম উঠে যায়। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা অভিমুখী। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা এবং মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত হয়।’ (মুসলিম: ২৬০৭)
যেসব মিথ্যা নিয়ে মানুষ অসচেতন
এমন কিছু মিথ্যা রয়েছে, যাকে সমাজের মানুষ মিথ্যা মনে করে না, অথচ এতে মিথ্যা বলার পাপ হয়। যেমন—
১) যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কথা বলে বেড়ান। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কারো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শোনে (কোনো বাছ-বিচার ছাড়া) তাই প্রচার করতে থাকে। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯২)
২) গণমাধ্যমে অসত্য প্রচার। গণমাধ্যমে অসত্য বা অর্ধ-সত্য প্রচার করা, মানুষকে বিভ্রান্ত করা মিথ্যাতুল্য অপরাধ। মেরাজের রাতে রাসুল (স.)-কে বিভিন্ন অপরাধীদের শাস্তি দেখানো হয়—এক লোক বসা, পাশে আরেকজন দাঁড়ানো। তার হাতে লোহার পেরেক। লোহার পেরেক দিয়ে এই লোক পাশের লোকটির চোয়ালে আঘাত করে এবং পেরেকটি তার চোয়ালে ঢুকিয়ে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর একইভাবে অপর চোয়ালে আঘাত করে। ততক্ষণে আগের চোয়াল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং সে আবার আঘাত করতে থাকে। এ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়—সে ছিল মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলত এবং তা প্রচার করত। ফলে তার বলা মিথ্যা প্রচার হতে হতে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ত। (সহিহ বুখারি: ১৩৮৬)
৩) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে কোনো মুসলমানের হক বিনষ্ট করল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেবেন এবং জান্নাত তার ওপর হারাম করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১৩৭)
৪) ব্যবসায় মিথ্যা। মিথ্যা বলে গ্রাহককে প্রলুব্ধ করা মিথ্যা। হাদিসে এসেছে, ‘এটা অনেক বড় খেয়ানত যে তুমি তোমার ভাইকে কোনো কথা বলছ, সে এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করছে অথচ তুমি এতে মিথ্যাবাদী।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭১)
৫) মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া মুনাফেকির নিদর্শন। হাদিসে এসেছে, ‘মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি; কথা বললে মিথ্যা বলে। ওয়াদা করে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৯)
৬) শিশুদের সঙ্গে মিথ্যা। বাচ্চাদের মন ভোলানো বা তাদের কান্না থামানোর জন্য তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেওয়া মিথ্যার নামান্তর। মহানবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে বলল, এসো তোমাকে (এটা-সেটা) দেব। তারপর দিল না; এটিও একটি মিথ্যা।’ (মুসনাদে আহমদ: ৯৮৩৬)
৭) ঠাট্টার ছলে মিথ্যা। নবী করিম (স.) বলেন, ‘ধ্বংস তার জন্য, যে মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলার সময় মিথ্যা বলে! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য!’ (সুনানে আবি দাউদ: ৪৯৯০)
৮) স্বপ্ন দেখেছে বলে মিথ্যা। অনেকের মধ্যে মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করার প্রবণতা আছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো স্বপ্ন দেখেছে বলে দাবি করল, অথচ সে তা দেখেনি, তাহলে তাকে দুটি জব একত্রে জোড়া দিতে বাধ্য করা হবে অথচ সে তা কখনোই করতে পারবে না।’ (বুখারি: ৭০৪২; তিরমিজি: ২২৮৩)
৯) অহেতুক ধারণা করার মাধ্যমে মিথ্যা। অহেতুক অনুমান করার মাধ্যমেও মিথ্যা বলার গুনাহ হয়ে যায়। তাই অযথা কাউকে কোনো ব্যাপারে কুধারণা পোষণ করা যাবে না। হাদিসে এসেছে, ‘ধারণা-অনুমান সম্পর্কে তোমরা সাবধান হও। কারণ অলীক ধারণা পোষণ সবচেয়ে বড় মিথ্যা...। (সহিহ বুখারি: ৬০৬৬)
যেসব ব্যাপারে মিথ্যা বলার অনুমতি আছে
অতি প্রয়োজনীয় কোনো কল্যাণ অর্জনের জন্য অথবা নিশ্চিত কোনো অঘটন থেকে বাঁচার জন্য কারো অধিকার বিনষ্ট না করে ঘুরিয়ে এমনভাবে কথা বলা যায়, যা অসত্য নয়। ইমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, ‘ঘুরিয়ে কথা বললে জাজ্বল্য মিথ্যা বলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।’ (বায়হাকি: ১০/১৯৯)
জনকল্যাণে কিংবা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে মিথ্যা বলার অবকাশ আছে। উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি মিথ্যুক নয় যে মানুষের পরস্পর বিরোধ মীমাংসা করে এবং সে ওই উদ্দেশ্যেই ভালো কথা বলে এবং তা বানিয়ে বলে।’ (বুখারি: ২৬৯২; মুসলিম: ২৬০৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে তিন স্থানে মিথ্যা বলার সুযোগ আছে। উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.) আরো বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) শুধু তিনটি ব্যাপারে মিথ্যা বলার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি বলতেন, ‘আমি মিথ্যা মনে করি না যে কোনো ব্যক্তি মানুষের পরস্পর বিরোধ মীমাংসার জন্য কোনো কথা বানিয়ে বলবে। তার উদ্দেশ্য শুধু বিরোধ মীমাংসা। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জেতার জন্য কোনো কথা বানিয়ে বলবে। তেমনি কোনো পুরুষ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে এবং কোনো নারী নিজ স্বামীর সঙ্গে কোনো কথা বানিয়ে বলবে।’ (আবু দাউদ: ৪৯২১)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মিথ্যার পরিণাম সম্পর্কে জানার বুঝার ও মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।