images

ইসলাম

হিংসার আগুনে দগ্ধ হয় হিংসুক নিজেই

ধর্ম ডেস্ক

৩১ জুলাই ২০২২, ০১:৪৮ পিএম

কারো অগ্রগতি দেখলে কষ্ট পাওয়া এবং তার ধ্বংস কামনা করা কিংবা ধ্বংস হয়ে গেলে আনন্দিত হওয়াই হচ্ছে হিংসা। হিংসা একটি ভয়াবহ আত্মিক রোগ। এই রোগ থাকলে কেউ পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না। উপরন্তু নিজেকেই জলে পুড়ে ছাই হতে হয়।

তাই হিংসা রোগ থেকে নিরাময়ের জন্য আত্মিক চিকিৎসা প্রয়োজন। অল্পতে তুষ্ট থাকা, অন্তর থেকে লোভ-লালসা বের করে দেওয়া এবং যার প্রতি হিংসা হয় তার জন্য দোয়া করা ও সালাম বিনিময় করাই হচ্ছে হিংসা রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করার উত্তম চিকিৎসা। 

হিংসা এমন এক ব্যাধি, যা শুধু মনের নয়, দেহেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বলা হয়ে থাকে যে, হিংসুক মানুষের কোনো বিশ্রাম (ঘুম) নেই ও সে বন্ধুর লেবাসে একজন শত্রু । হিংসা হিংসুককেই প্রথমে হত্যা করে। তাকে তিলে তিলে ক্ষয় করে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘..বলে দাও, তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মরো..।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১৯)

মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা কাউকে নেয়ামত বা সফলতা দিতে চাইলে তাকে ব্যর্থ করার ক্ষমতা দুনিয়ার কারো নেই। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মানুষের প্রতি কোনো অনুগ্রহ অবারিত করলে কেউ তা নিবারণকারী নেই এবং তিনি কিছু নিরুদ্ধ করতে চাইলে কেউ তার উন্মুক্তকারী নেই। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।’ (সুরা ফাতির: ২)

মুসলমান মুসলমানে হিংসা আল্লাহর জিকির থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সর্বোপরি অন্যান্য নেক আমল এবং দীন-ধর্মও ধ্বংস করে দেয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো কেননা হিংসা নেক আমল এমনভাবে খেয়ে ফেলে (ধ্বংস করে দেয়) যেমন আগুন কাঠখণ্ডকে খেয়ে ফেলে (জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়)।' (সুনানে আবি দাউদ: ৪৯০৩)

আরও ইরশাদ হয়েছে, পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ব্যাধি তোমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে- হিংসা ও বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ মুণ্ডণ করে দেয়। আমি বলি না যে- তা চুল মুণ্ডণ করে, বরং তা দীন বা ধর্মকে মুণ্ডণ ও ধ্বংস করে দেয়। যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, বিশ্বাসী না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পরস্পর একে অন্যকে ভালো না বাসলে তোমরা বিশ্বাসী বা মুমিন হতে পারবে না। এই ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম আমি শিখিয়ে দিচ্ছি, সর্বত্র ও সর্বদা পরস্পরে সালাম প্রদানের প্রথা প্রচলিত রাখবে। (তিরমিজি: ২৫১০)

হিংসুকরা আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা লাভ থেকেও বঞ্চিত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, প্রতি সপ্তাহে দুইদিন—সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দাদের কর্ম (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। তখন সব মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, শুধু ওই ব্যক্তি ছাড়া, যার ও তার অন্য ভাইয়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতা আছে। এদের বিষয়ে বলা হয়, এদের বিষয় স্থগিত রাখো, যতক্ষণ না এরা ফিরে আসে। (মুসলিম: ২৫৬৫)

অন্য হাদিসে মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত্রে (১৪ই শাবানের দিবাগত রাতে) আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং তাঁর সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, শুধু শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ভাইয়ের বিদ্বেষ আছে তারা ছাড়া। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ: ১১৪৪)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, খবরদার! হিংসা থেকে আত্মরক্ষা করবে; কারণ হিংসা এমনভাবে নেক কর্ম ধ্বংস করে ফেলে, যেভাবে আগুন খড়ি বা খড়কুটো পুড়িয়ে ফেলে।’ হাদিসটির সনদে দুর্বলতা আছে, তবে ওপরের হাদিসের অর্থ তা সমর্থন করে। (আবু দাউদ: ৪৯০৩)

তা ছাড়া হিংসা-বিদ্বেষ জান্নাতে প্রবেশের অন্তরায়। তাই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জান্নাত দেওয়ার আগে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে তাদের অন্তরকে পবিত্র করবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ বের করে ফেলব, তারা সেখানে ভাই ভাই হয়ে আসনে মুখোমুখি বসবে।’ (সুরা হিজর: ৪৭)

অতএব জান্নাতে যেতে চাইলে আগে থেকেই পরিশুদ্ধ অন্তর অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। কারো প্রতি দুনিয়াবি কারণে ক্ষোভ পোষণ করা যাবে না, কারো ক্ষতি করার পাঁয়তারা করা যাবে না। এগুলো মানুষকে আল্লাহর দয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলা হলো, ‘কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি বলেন, প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি। তাঁরা বলেন, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনি; কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, সে হলো পূত-পবিত্র নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ যার কোনো গুনাহ নাই, নাই কোনো দুশমনি, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্ম-অহমিকা ও কপটতা।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২১৬)

জান্নাতি লোকের বৈশিষ্ট্যই হলো তার জীবনে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। কেননা এটি জান্নাতি লোকের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। জান্নাতি লোকমাত্রই এসব নোংরা স্বভাব থেকে পবিত্র থাকবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘প্রথম যে দল জান্নাতে প্রবেশ করবে তারা পূর্ণিমার চাঁদের উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে প্রবেশ করবে আর তাদের পর যারা প্রবেশ করবে তারা অতি উজ্জ্বল তারার মতো আকৃতি ধারণ করবে। তাদের অন্তরগুলো এক ব্যক্তির অন্তরের মতো থাকবে। তাদের মধ্যে কোনো রকম মতভেদ থাকবে না আর পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের প্রত্যেকের দুজন করে স্ত্রী থাকবে। সৌন্দর্যের কারণে গোশত ভেদ করে পায়ের মজ্জা দেখা যাবে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করবে। তারা রোগাক্রান্ত হবে না, নাক ঝাড়বে না, থুথু ফেলবে না। তাদের পাত্রসমূহ হবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের আর চিরুনিসমূহ হবে স্বর্ণের। তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধি কাঠ।’ (সহিহ বুখারি: ৩২৪৬)

একজন ইমানদারের জন্য নিজেকে হিংসামুক্ত রাখা যেমন জরুরি, তেমনি সর্বদা হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করাও জরুরি। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, 'আর (তুমি বলো, আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।' (সুরা ফালাক: ৫)

নবীজি (স.) আমাদের হিংসা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। হাদিস শরিফে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না, একে অন্যের বিরুদ্ধাচরণ করো না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য তিন দিনের অধিক তার ভাইকে ত্যাগ করে থাকা বৈধ নয়’ (বুখারি: ৬০৬৫)। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।