images

ইসলাম

শিশু মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে দুধমা হালিমার চমকপ্রদ বর্ণনা

ধর্ম ডেস্ক

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:২২ এএম

স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা ও বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শেখানোর জন্যে শহুরে আরবদের প্রচলন ছিল গ্রামের নারীদের কাছে নবজাতকদের সোপর্দ করা। বেদুইন নারীরা অভিজাত ঘরের এসব দুগ্ধপোষ্য শিশুদের লালন ও দুগ্ধপান করানোর বিনিময়ে সম্মানী লাভ করতেন। সুদূর তায়েফ থেকে এক কাফেলা দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে মক্কায় আসে এবং প্রত্যেকে একটি করে শিশু পেয়ে যান। পিতৃহীন শিশু মুহাম্মদ (স.)-কে কাফেলার কেউ সম্মানী না পাওয়ার আশঙ্কায় নিয়ে যেতে সম্মত হননি। শেষমেশ কাফেলার সবচেয়ে দূর্বল নারী হালিমা সাদিয়া খালি হাতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে মুহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে যাওয়াকে পছন্দ করেন এবং রাহমাতুল্লিল আলামিনের দুধমা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

হালিমা (রা:) বলেন, দুর্ভিক্ষের বছর আমরা দুগ্ধপোষ্য শিশু গ্রহণ করতে মক্কায় গিয়েছিলাম। তখন আমাদের ছিল বয়স পেরিয়ে যাওয়া শীর্ণকায় দুটি উষ্ট্রী। দুধ পেতাম না এক ফোটাও। আল্লাহর কসম— সেসময় আমার শিশু তীব্র ক্ষুধায় কান্না করত। আমরা রাতে এক মুহূর্তও ঘুমাতে পারতাম না। কেননা আমার সামান্য দুধে তার পেট ভরত না, উষ্ট্রীর ওলানেও দুধ ছিল না তাকে খাওয়ানোর মতো। শীর্ণকায় বাহনের গতি এতই ধীর ছিল যে, কাফেলা থেকে বারবার পিছনে ছিটকে পড়ছিলাম। কিন্তু তাকে (শিশু মোহাম্মদ (স.)-কে কোলে বসিয়ে যখন স্তন তার মুখে পুরে দিলাম তখনই স্তন ভরপুর হয়ে উঠল। শিশুটি খেয়ে পরিতৃপ্ত হল। এরপর তার দুধভাইও খেয়ে পরিতৃপ্ত হল।

দুধ খেয়ে দুভাই ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ও আমার স্বামীও শুয়ে পড়লাম ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। কারণ এতদিন ঘুমিয়েছি খুব সামান্যই। হঠাৎ আমার স্বামীর দৃষ্টি পড়ল উষ্ট্রী দুটির দিকে। তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে এগিয়ে গেলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দেখলেন ওলানভরা দুধ। এরপর তিনি দুধ দোহন করলেন, নিজে পান করলেন, আমিও পান করলাম। দু’জনেই পরিতৃপ্ত হয়ে জীবনের সেরা সুখময় একটি রাত কাটালাম।

এবার বাড়ি ফেরার উদেশ্যে মক্কা থেকে বের হলাম। শিশুটিকেও নিলাম আমার সঙ্গে। বিস্মিত হয়ে দেখলাম— আমাদের বুড়ী ও দুর্বল উষ্ট্রীটি এমন প্রফুল্ল গতিতে চলছে যে, কওমের সকল বাহনকে পেছনে ফেলে দিল। তখন আমার সঙ্গিনীরা বলতে লাগল— আরে ও আবু যুআইবের মেয়ে! তুমি তো আমাদের অস্থির করে ছাড়লে, আমাদের কি সঙ্গে নেবে না? এটিই কি সেই বুড়ি উটনী, আসার সময় সারা পথ যেটি আমাদের বিরক্ত করেছিল?

এভাবে সাদ গোত্রে পৌঁছানোর পর অব্যাহত বরকত ও কল্যাণ পেতেই থাকলাম। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো— আমাদের মেষপাল সারা বেলা চরে বেড়াত খরাকবলিত চারণভূমিতে! আর সন্ধ্যায় ফিরে আসলে ইচ্ছেমতো দুধ দোহন করতাম এবং পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করতাম। অথচ অন্যরা তাদের মেষ পাল থেকে এক ফোঁটা দুধও পেত না। কওমের লোকেরা নিজেদের রাখালদের বলতে শুরু করল যে, তোমরা করছোটা কী? হালিমার রাখালের সঙ্গে থেকে মেষ চরাতে পারো না? নির্দেশমতো সেই রাখালেরাও আমাদের মেষগুলোর আশপাশ দিয়ে মেষ চরাতে থাকল। কিন্তু তাদের মেষগুলোর অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। এমন সুখের মধ্যে দুবছর পেরিয়ে গেল। শিশুকে দুধ ছাড়ানো হল। তার শারীরিক-মানসিক বিকাশ এতই চমৎকারভাবে ঘটল যে, সাধারণত এরকম দেখা যায় না। আমরা তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম। তাকে নিজের কাছে রেখে দেয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা নিজের মধ্যে গোপন রেখে তার মাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আরো একটু বড় ও শক্ত হওয়া পর্যন্ত ওকে আমার কাছে রাখলেই ভাল হয়, কারণ মক্কায় মহামারীর কারণে আমার ভয় হচ্ছে… এভাবে তার মাকে রাজি করিয়ে আবারও তাকে নিয়ে খুশিতে হাসতে হাসতে বাড়িতে ফিরে এলাম।

কয়েক মাস যেতে না যেতে এমন এক ঘটনা ঘটল যা আমাদের আতঙ্কিত করে দিল। এক সকালে ভেড়ার পাল চরাতে সে তার ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ির পেছনে গেল। একটু পরে তার ভাই ছুটে এসে বলল— “ছুটে এসো, দেখো কুরাইশি ভাইয়ের কী হয়েছে, সাদা পোশাকের দুই লোক এসে তাকে মাটিতে শোয়ালো এবং তার বুক চিরে ফেলল। আমি ও আমার স্বামী এক দৌঁড়ে সেখানে গেলাম। দেখলাম তার চেহারার রঙ ফ্যাকাশে, চোখে-মুখে ভীতির ছাপ। আমার স্বামী ব্যাকুল হয়ে তার পাশে বসে পড়ল। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে বললাম— কী হয়েছে বাবা? সে বলল— সাদা জামা পরা দুই লোক এসে আমাকে শোয়ালো, আমার বুক চিরে কী যেন খুঁজল। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা অস্থির ও শঙ্কিত হলাম। পেরেশানিতে পড়ে গেলাম। যখন তাকে নিয়ে বাড়িতে গেলাম, দেখলাম আমার স্বামীর দুচোখে অশ্রুর প্লাবন। 

তিনি বললেন— আমার ভয় হচ্ছে। না জানি এই মুবারক শিশুটির কোনো বিপদ ঘটে, যা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই…। তাকে তার পরিজনের কাছে পৌঁছে দিলেই ভালো হবে। তারাই পারবে যেকোনো ব্যাপার সামাল দিতে। আমরা যখন শিশুটিকে তার তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম, তখন তিনি তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি বুলিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার হালিমা! এতো আগ্রহের সঙ্গে নিয়ে গেলে, কিন্তু দ্রুতই ফেরৎ দিতে চলে আসলে!

আমি জবাব দিলাম, তার শৈশবকাল পূর্ণ হয়েছে, আমার দায়িত্বের মেয়াদটাও প্রায় শেষ। নানা দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে নিরাপদ রাখার ইচ্ছায় ফেরৎ দিতে এসেছি। আমার এই জবাবে তিনি সন্তুষ্ট হননি, বরং পীড়াপীড়ি করতেই থাকলেন আসল ঘটনা না জানা পর্যন্ত। সবকিছু শুনে তিনি প্রশ্ন করলেন— তার ওপর শয়তানি প্রভাবের আশঙ্কা হচ্ছে তোমার? আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। এবার দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি বললেন— আল্লাহর কসম! শয়তান কখনওই তার কাছে ঘেঁষতে পারবে না। কারণ আমার ছেলের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তুমি কি সেটা জানতে চাও? আমি বললাম, অবশ্যই জানতে চাই।

এরপর তিনি বললেন, নিয়ে যখন এসেছ ওকে রেখে যাও। আমাদের সকলের পক্ষ থেকে এবং ওর পক্ষ থেকে তোমাকে জাযাকাল্লাহু খায়রান (আল্লাহ তোমাকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন)। এরপর আমি ও আমার স্বামী ব্যথিত হৃদয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম। এই বিচ্ছেদ ব্যথার কষ্টকর প্রভাব আমার শিশুটির মনেও পড়ল। সেও সাথী হারানোর বেদনায় আমাদের মতোই বেদনার্ত হয়ে পড়ল। 

হালিমা সাদিয়া দীর্ঘকাল বেঁচেছিলেন। নিজের চোখে দেখেছেন তাঁর দুধ খাওয়া শিশুটি আরবজাতির অবিসংবাদিত নেতা ও ইনসানিয়্যাতের রাহবার হয়েছেন। রাহমাতুল্লিল আলামিন। তিনি ইমান এনেছেন তাঁর প্রতি ও তাঁর উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থের প্রতি। একদিন হাজির হলেন বিশ্বনবী (স.)-এর সামনে। যেইমাত্র দুধমাকে দেখলেন, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন রাসূলুল্লাহ (সা.। ভক্তি ও শ্রদ্ধায় বলতে লাগলেন— উম্মী উম্মী (আমার মা, আমার মা)। মহানবী (স.) নিজের গায়ের চাদর খুলে বিছিয়ে দিলেন তাঁর বসার জন্য। তাঁর আগমনে চূড়ান্ত সম্মান ও মর্যাদার প্রকাশ ঘটালেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম বিস্মিত চোখে শুধু তাকিয়ে রইলেন। (সূত্র: সীরাতে ইবনে হিশাম, নারী সাহাবীদের ঈমানদীপ্ত জীবন)

এমএ/