ধর্ম ডেস্ক
১৭ জুলাই ২০২২, ০৫:৪৩ পিএম
অতিরিক্ত টাকা না নেওয়ার শর্তে ঋণ বা লোন নেওয়া জায়েজ। অন্যথায় ব্যাংক থেকে হোক বা যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হোক ঋণ নেওয়া জায়েজ নেই। কেননা ‘যে ঋণ কোনো মুনাফা নিয়ে আসে, তা রিবার প্রকারসমূহের একটি। (সুনানে বায়হাকি: ৫/৩৫০)
ইমাম মালেক (রহ) বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনোকিছু ঋণ দেবে, সে যেন অতিরিক্ত কোনো কিছু শর্ত না করে। যদিও তা এক মুঠো ঘাস হোক না কেন।’ (মুআত্তা মালেক: ২৫১৩)
সুতরাং সুদি ঋণ কোনো অবস্থায়ই জায়েজ নেই। এতে কোনো আলেমের দ্বিমতও নেই। কিন্তু যে ঋণ সুদমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে মানুষের বিশ্বাস আছে, তেমনই এক ইসলামি পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা করবো। প্রচলিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতিটির নাম বাইয়ে মুরাবাহা। এই পদ্ধতিতে মূলত ঋণ হিসেবে টাকা দেওয়া হয় না; দেওয়া হয় পণ্য। আর এই পদ্ধতিও জায়েজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে।
অর্থাৎ যদি ঋণ হিসেবে পণ্য (যেমন সিমেন্ট, রড, ব্যবসায়ী সামগ্রী ইত্যাদি) নেওয়া হয়, তাহলে নিম্নোক্ত শর্তের ভিত্তিতে জায়েজ, অন্যথায় জায়েজ নেই। (শর্তগুলো লিখেছেন মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ)
ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থার শুরুতে যুগের ফকিহগণ অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু শর্তসাপেক্ষে ব্যাংকগুলোকে মুরাবাহা করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং যত দ্রুতসম্ভব ব্যাপকভাবে মৌলিক ও আদর্শ বিনিয়োগ মুদারাবা চালু করার প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন।
শর্তাবলি
প্রচলিত মুরাবাহা জায়েজ হওয়ার শর্তগুলো নিম্নরূপ:
১) ব্যাংকের মালিকানায় ও দখলে পণ্য আসার আগে তা বিক্রি করতে পারবে না। অর্থাৎ বিনিয়োগগ্রহীতা ব্যাংকের কাছে পণ্য চাওয়ার পর প্রথমে ব্যাংককে তা খরিদ করতে হবে এবং হস্তগত করতে হবে। এরপর ক্লায়েন্ট-এর নিকট তা বিক্রি করতে পারবে।
২) কোনো না-জায়েজ বা হারাম পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না।
৩) ব্যাংক যে পণ্য গ্রাহকের কাছে বিক্রি করবে, তা যদি এমন হয় যে, গ্রাহক নিজেই এর মালিক এবং সে ব্যাংকের কাছে তা নগদে কমমূল্যে বিক্রয় করে পরে আবার বাকিতে বেশি মূল্যে তা ক্রয় করে নেয়, তখন কারবারটি হারাম হবে এবং সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ যার কাছে বিক্রি করবে তার থেকেই পণ্যটি খরিদ করেছে—এমন হওয়া চলবে না।
৪) বাস্তবভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয় হতে হবে। এমন যেন না হয় যে, কোনো দোকানে আগে থেকেই ব্যাংকের এমন চুক্তি রয়েছে যে, আমরা তোমার কাছ থেকে কোনো পণ্য খরিদ করে গ্রাহকের নিকট বিক্রি করলে সে আবার তোমার নিকট কম মূল্যে তা বিক্রি করে দিবে। এমন টাল-বাহানা করা যাবে না।
৫) কারবারটি এমন হতে হবে যাতে বাস্তবেই ক্রেতার (ক্লায়েন্ট) ওই পণ্যের জন্য অর্থ দরকার। যদি শুধু পণ্যের নাম ব্যবহার করে নগদ টাকা ঋণ নেয়, বাস্তবে পণ্য খরিদের কোনো ইচ্ছা নেই, তাহলে কারবারটি হারাম হবে।
৬) ব্যাংকের কাছে বিনিয়োগপ্রার্থী (ক্লায়েন্ট) যদি এমন জিনিস খরিদের নামে টাকা নেয়, যা আগেই সে খরিদ করে ফেলেছে অথবা তা কাজে লাগিয়ে ফেলেছে এখন সেসব পণ্যের বকেয়া মূল্য পরিশোধের জন্য অথবা টাকার অন্য কোনো প্রয়োজন হওয়ায় ওই পণ্যের নামে ব্যাংকের সঙ্গে মুরাবাহা করছে, তবে তা-ও হবে হারাম ও সুদি কারবার।
উল্লেখ্য যে, ৫ ও ৬ নম্বর ত্রুটিগুলো স্বাভাবিকভাবে হয়ে থাকে। কারণ, ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রেই নিজে পণ্য খরিদ করতে যায় না এবং তা নিজ রিস্কে নেয় না।
৭) মুরাবাহার একটি অপরিহার্য শর্ত হলো, পণ্যটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ব্যাংকের দায়িত্বে থাকতে হবে এবং ওই সময়ে সেটি নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা ব্যাংকের ক্ষতি বলেই ধর্তব্য হবে। যদি মুরাবাহার পণ্য গ্রাহককে বিক্রির আগে এমন কোনো ঝুঁকি ব্যাংক বহন না করে, তাহলে কারবার হারাম হবে।
মাওলানা তাকি উসমানি এবং অন্যান্য ফকীহগণের (যারা ব্যাংকের মুরাবাহার অনুমোদন দিয়েছেন) মতে এটিই একমাত্র শর্ত যা মুরাবাহাকে সুদি কারবার থেকে ভিন্ন করে। কারণ সুদি লোনের মধ্যে ব্যাংক ক্লায়েন্টকে টাকা দেওয়ার পর তার কোনো ঝুঁকি সে বহন করে না। এখন যদি মুরাবাহাতেও এমনটি ঘটে এবং গ্রাহক তথা ক্লায়েন্টকে পণ্য হস্তান্তরের পূর্বে ব্যাংক তার ঝুঁকি গ্রহণ না করে তবে কারবারটি হবে সুদি লেনদেনের নামান্তর।
৮) মুরাবাহার আরেকটি শর্ত হলো ক্লায়েন্টের কাছে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করে দেওয়ার পর তা আর বৃদ্ধি করা যাবে না। অর্থাৎ সনাতনী ব্যাংকগুলো যেমন বছরান্তে বা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, সেভাবে মুরাবাহা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না। করলে তা সুদ হবে।
উপরোক্ত সব শর্ত মেনে ব্যাংক যদি টাকা না দিয়ে বাকিতে পণ্য দিয়ে দেয়, যার মূল্য বাজারমূল্য থেকে বেশি এবং ব্যাংক কিস্তিতে ওই মূল্যবাবৎ টাকা প্রদানের সুযোগ দেয়, তাহলে তা জায়েজ হবে।
উল্লেখ্য, ইসলামি রুলস মেনে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু না থাকলে, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ব্যাংকে টাকা না রাখা উত্তম। কিন্তু জরুরত বা অতীব প্রয়োজন হওয়ার কারণে একাউন্ট খোলা জায়েজ। তখন সতর্কতামূলক লভ্যাংশ সওয়াবের নিয়ত ছাড়া দান করে দিতে হবে। হাদিস অনুযায়ী, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, তার সাক্ষী যে হয়, আর দলিল যে লিখে তাদের সকলেরই ওপর আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ: ৩৮০৯, মুসনাদে আবি ইয়ালা: ৪৯৮১)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সুদি কারবার থেকে রক্ষা করুন। হারাম থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে এই কারবারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।