images

ইসলাম

অল্প সময়ে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা সেই মুসলিম শাসক

ধর্ম ডেস্ক

২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৫ পিএম

উমাইয়া খেলাফতের ইতিহাসে কিছু নাম আছে, যেগুলো ক্ষমতার জাঁকজমকের জন্য নয়; বরং ন্যায়, সংযম ও নৈতিক সাহসের জন্য স্মরণীয়। হজরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) ছিলেন সেই ব্যতিক্রমী শাসক। তাঁকে ‘দ্বিতীয় ওমর’ বলা হয়। তাঁর আড়াই বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলেই তিনি যে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর শাসনকালকে নতুনভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।

ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে থেকেও তিনি রাষ্ট্রকে দেখেছেন ‘আমানত’, আর শাসনকে মনে করেছেন ‘ইবাদত’। আজকের বিশ্বে যখন সুশাসন সংকটগ্রস্ত, তখন ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর জীবন ও রাষ্ট্রচিন্তা সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এক অনিবার্য নৈতিক রেফারেন্স।

সুশাসনের সাত স্তম্ভ: ওমর বিন আব্দুল আজিজের রাষ্ট্রদর্শন

১. যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ: তাকওয়াই একমাত্র মানদণ্ড

ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন- একজন শাসকের একার পক্ষে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়; প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে সৎ ও আল্লাহভীরু লোক না থাকলে সুশাসন ব্যর্থ হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন করেন। নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান খালিদ বিন রাইয়ানকে অপসারণ করে আমর বিন মুহাজিরকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি বলেন- ‘আল্লাহর কসম! হে আমর, তোমার ও আমার মধ্যে ইসলাম ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি তোমাকে অধিক কোরআন তেলাওয়াত করতে শুনেছি এবং গোপনে সুন্দরভাবে নামাজ আদায় করতে দেখেছি-এই কারণেই তোমাকে দায়িত্ব দিলাম।’ (ইবনে আব্দুল হাকাম, সীরাতু ওমর বিন আব্দুল আজিজ)

২. বৈধ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি: দুর্নীতির শেকড়ে আঘাত

তিনি জানতেন- রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত রাখতে হলে তাদের জন্য যথেষ্ট বৈধ আয় নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভাতা ১০০ থেকে ২০০ দিনার পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। কিন্তু নিজে বা তাঁর পরিবার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা নেননি।

‘আমি কর্মচারীদের তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারি না, আর আমার পরিবারকে অন্যের অধিকার দিতে পারি না।’ (সূত্র: আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ)

আরও পড়ুন: ইসলামে শাসকের ১৩ দায়িত্ব

৩. উপহার গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা: ঘুষ ও উপহারের নৈতিক সীমারেখা

খলিফা হওয়ার পর তিনি নিজে কোনো উপহার গ্রহণ করেননি এবং সকল কর্মকর্তার জন্য তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেন। যখন বলা হলো- রাসুলুল্লাহ (স.) তো উপহার গ্রহণ করতেন, তিনি জবাব দেন- ‘তা রাসুলের জন্য ছিল উপহার; কিন্তু আমাদের জন্য এবং আমাদের পরবর্তীদের জন্য ঘুষ।’ (ইমাম জাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা)

৪. রাষ্ট্রীয় সম্পদের পবিত্রতা: অপচয়ের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা

ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) রাষ্ট্রীয় সম্পদকে পবিত্র আমানত হিসেবে দেখতেন। খেলাফত গ্রহণের সময় তাঁর জন্য বিশেষ বাহন তৈরি হলে তিনি নির্দেশ দেন- ‘এটি বায়তুল মালে ফেরত দাও।’ নিজের পুরোনো খচ্চরেই তিনি রাজদরবারে যেতেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় কালি ও কলমও ব্যবহার করতেন না।

ইবনে খালদুন এই নীতির ব্যাখ্যায় বলেন- ‘শাসকদের বিলাসিতা ও ব্যবসা উভয়ই প্রজাদের জন্য ক্ষতিকর।’ (ইবনে খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা)

৫. জনগণের অংশগ্রহণ: শাসনের দরবার সবার জন্য উন্মুক্ত

তিনি ঘোষণা দেন- যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরবে ও কল্যাণকর পরামর্শ দেবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে। সত্য প্রকাশে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিকে ১০০ থেকে ৩০০ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করা হতো। এই নীতি রাষ্ট্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

আরও পড়ুন: যে শাসকের দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না 

৬. কঠোর জবাবদিহিতা: আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়

তিনি আগের প্রশাসকদের কাছ থেকেও রাষ্ট্রীয় সম্পদের হিসাব তলব করেন। খোরাসানের গভর্নর ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাব রাষ্ট্রীয় অর্থ জমা না দেওয়ায় গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি হন। এই ঘটনা প্রমাণ করে- তাঁর শাসনে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই আইনের ঊর্ধ্বে ছিল না।

৭. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার: ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নাগরিক অধিকার

তিনি প্রথম উমাইয়া খলিফা যিনি রাষ্ট্রীয় সহায়তা কেবল মুসলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সকল দরিদ্র নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করেন। অমুসলিম নাগরিকদের প্রসঙ্গে তাঁর ঘোষণা ছিল সুস্পষ্ট- ‘যে ব্যক্তি কোনো জিম্মিকে অন্যায়ভাবে আঘাত করবে, কেয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে অবস্থান করব।’ (আবু দাউদ, মাআনাভিত্তিক)

অর্থনৈতিক বিপ্লব: যখন দান নেওয়ার মানুষ পাওয়া যায়নি

ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর শাসনামলে এমন অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা সৃষ্টি হয় যে জাকাত গ্রহণের মতো মানুষ পাওয়া যেত না। তাঁর ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতি এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র সমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যুকালে বায়তুল মালে এত সম্পদ জমা ছিল যে প্রদেশগুলো নতুন সম্পদ ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা চাইছিল। (সূত্র: ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

ব্যক্তিগত ত্যাগ: রাজপ্রাসাদে বসবাসকারী দরবেশ

ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল চরম সরল। স্ত্রী ফাতিমা বিনতে আব্দুল মালিককে তিনি বলেন- ‘এই জীবন অথবা গহনা একটিই বেছে নাও।’ মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পদ ছিল মাত্র ১৭ দিরহাম একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনযাত্রার সঙ্গেও যা সঙ্গতিপূর্ণ। এই ত্যাগই তাঁকে ইতিহাসের অন্যতম ন্যায়পরায়ণ শাসকে পরিণত করেছিল।

আরও পড়ুন: সৎ নেতা বাছাইয়ের অলৌকিক ফল: আল্লাহর রহমত নেমে আসে ৫ ভাবে

ইতিহাসের চিরন্তন শিক্ষা

১০১ হিজরিতে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এই মহান শাসকের ইন্তেকাল হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বিষপ্রয়োগে শহিদ হন। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন এমন এক রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ, যা যুগে যুগে ন্যায় ও ইনসাফের মানদণ্ড হয়ে থাকবে।

ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) প্রমাণ করে গেছেন- সৎ ইচ্ছা, আল্লাহভীতি ও ন্যায়নিষ্ঠতা থাকলে অল্প সময়েই একটি রাষ্ট্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তিনি ইতিহাসের পাতায় শুধু একটি নাম নন; তিনি ন্যায়ের চিরজাগরূক বিবেক। তাঁর জীবন ও শাসনকালের শিক্ষা আজও সমান প্রাসঙ্গিক: ন্যায়ই টিকে থাকে, অন্যায় ধ্বংস হয়; সততাই শক্তি, অসততা দুর্বলতা; জনগণের সেবাই প্রকৃত শাসন, আর ব্যক্তিস্বার্থই শাসনের পতন ঘটায়।