ধর্ম ডেস্ক
১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:০১ পিএম
আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামের ইতিহাস এক গৌরবময় অধ্যায়। এই ইতিহাসের সূচনালগ্নেই উঠে আসে সুদান ও তার সংলগ্ন অঞ্চলের নাম, যা আফ্রিকায় ইসলামের প্রথম আলো ছড়ানোর প্রবেশদ্বার ও বিকাশের প্রাণকেন্দ্র।
মক্কায় চরম নির্যাতনের মুখে মহানবী মুহাম্মদ (স.)-এর নির্দেশে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে একদল সাহাবি লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে আকসাম অঞ্চলে হিজরত করেন। এই আকসাম অঞ্চলটি বর্তমান ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া ও সুদানের সীমান্তবর্তী এলাকা। ইসলামের ইতিহাসে এটিই প্রথম হিজরত হিসেবে স্বীকৃত।
প্রথম দলে ২৩ জন সাহাবি ছিলেন। পরের বছর আরও ১০১ জন মুসলমান এই অঞ্চলে হিজরত করেন। তাঁদের একটি অংশ আকসাম রাজ্যের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অবস্থান করেন, যা বর্তমান ইরিত্রিয়া ও সুদান-সংলগ্ন এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে। তৎকালীন আবিসিনিয়ার ন্যায়পরায়ণ শাসক নাজ্জাশি তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কোরআনের বাণী গভীর তাৎপর্য বহন করে- ‘আর যে কেউ আল্লাহর পথে হিজরত করে, সে আল্লাহর জমিনে বহু আশ্রয়স্থল ও প্রাচুর্য লাভ করবে।’ (সুরা নিসা: ১০০)
পরবর্তীতে ইসলামের ন্যায়, মানবিকতা ও মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে নাজ্জাশি নিজেও ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবেই সুদানি ভূখণ্ড ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আশ্রয় ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে ওঠে।
প্রথম হিজরতের এই ধারাবাহিকতায় উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার বারবারস বা লোহিত সাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক ‘দুই কিবলার মসজিদ’। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে ইরিত্রিয়ার মাসাওয়া অঞ্চলে নির্মিত ‘দুই কিবলার মসজিদ’কে আফ্রিকার অন্যতম প্রাচীন মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব স্থাপনা আফ্রিকায় ইসলামের প্রাথমিক ও স্থায়ী উপস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য বহন করে।
আরও পড়ুন: ইসলাম ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী
লোহিত সাগরের উপকূল ধরে মুসলিম বণিক ও ধর্মপ্রচারকরা ব্যবসা, নৈতিকতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করেন। তাদের দাওয়াতের পদ্ধতিতে মহানবীর এই নির্দেশনার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়- ‘মানুষের কাছে সহজতা অবলম্বন করো, কঠোরতা করো না; সুসংবাদ দাও, বিমুখ করো না।’ (সহিহ বুখারি)
৬৪১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর শাসনামলে মিসর বিজয় উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় ইসলামের প্রসারে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করে। এর ধারাবাহিকতায় ইসলামের প্রভাব নীলনদের উপত্যকা পেরিয়ে সুদানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে আরব বণিক, ইসলামি পণ্ডিত ও সুফি সাধকরা বাণিজ্য ও দাওয়াতের মাধ্যমে সুদানের সমাজে ইসলামের শেকড় দৃঢ় করেন। ইসলাম এখানে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও নৈতিক জীবনের ভিত্তিতে পরিণত হয়।
ইসলামের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সুদানে আরবি ভাষা ও লিপির চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। কোরআনের ভাষা হিসেবে আরবি শিক্ষা ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর ফলে ইসলাম কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও শাসনব্যবস্থার এক রূপান্তরমূলক শক্তিতে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন: ঈমানের দাওয়াত যারা পায়নি তাদের বিচার কীভাবে হবে
বর্তমানে সুদানের অধিকাংশ মুসলমান মালিকি মাজহাব অনুসারী সুন্নি। সুফি তরিকাগুলোর প্রভাব দেশটির ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত। রাজধানী খার্তুমে একটি ক্ষুদ্র শিয়া সম্প্রদায়ের উপস্থিতিও রয়েছে।
সুদানের রাজনীতিতেও ইসলামের প্রভাব সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিক মাহদি আন্দোলনের অনুসারী ‘আনসার’ গোষ্ঠী, বিভিন্ন সুফি তরিকা এবং মুসলিম ব্রাদারহুড দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক পরিসরে সক্রিয়। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা অভিবাসী কর্মীদের মাধ্যমে সালাফি আদর্শও শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করছে।
সুদানকে সূচনাবিন্দু ধরে ইসলামের আলো ধীরে ধীরে গোটা আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে উত্তর আফ্রিকা, সাহেল অঞ্চল এবং পশ্চিম আফ্রিকায় ইসলামের দ্রুত প্রসার ঘটে। আলমোরাভিড, মালি সাম্রাজ্য (মানসা মুসার শাসনামলে), সোনগাই সাম্রাজ্য এবং কানেম-বর্নুর মতো শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আফ্রিকায় ইসলামের রাজনৈতিক, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করে।
টিমবুকটু, জেনে ও কাইরুয়ান পরিণত হয় ইসলামি শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বখ্যাত কেন্দ্রে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিউনিসিয়ার কাইরুয়ান জামে মসজিদ, যা হজরত উকবা বিন নাফি (রহ.) ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে ৫০ হিজরিতে প্রতিষ্ঠা করেন।
সুদান তাই আফ্রিকায় ইসলামের প্রথম আশ্রয়, প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র এবং পরবর্তী বিস্তারের প্রবেশদ্বার। প্রথম হিজরতের সময় যে মানবিক আশ্রয়, ন্যায়বিচার ও শান্তিপূর্ণ সংলাপের সূচনা হয়েছিল, তা-ই পরবর্তীতে একটি সম্পূর্ণ মহাদেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানচিত্রকে নতুন রূপ দেয়। সুদানের মাটিতে রোপিত সেই বীজই আজ আফ্রিকার সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের সুগভীর, স্থায়ী ও গতিশীল প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করছে। ‘যে ভূমি ইসলামের প্রথম আশ্রয় হয়েছিল, সেই ভূমিই আফ্রিকায় ইসলামের সবচেয়ে গভীর শিকড় গড়ে দিয়েছে।’