ধর্ম ডেস্ক
০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৬ পিএম
মদিনার একদল দরিদ্র সাহাবি নবীজি (স.)-এর কাছে এসে মনের বেদনা প্রকাশ করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল! ধনী মুসলিমরা তো আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেল। তারা আমাদের মতো নামাজ-রোজা করছে, আবার তাদের সম্পদ দিয়ে হজ, ওমরা, সদকা ও জিহাদ করছে অতিরিক্ত সওয়াব পাচ্ছে। আমরা তো এসব করতে অক্ষম।’
এই কথায় রাসুলুল্লাহ (স.) একটি অসাধারণ সমাধান দিলেন যা ইসলামের ইতিহাসে ‘গরিবের হজ’ নামে পরিচিত হয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন একটি আমল শিখিয়ে দেব না; যা করলে তোমরা অগ্রগামীদের স্তরে পৌঁছে যাবে এবং যারা তোমাদের পেছনে তারা তোমাদের স্তরে পৌঁছতে পারবে না, তোমরা হবে শ্রেষ্ঠতম মানব, তবে অন্য কেউ এটি করলে সেও তোমাদের মতো হয়ে যাবে।’
রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৩ বার আল্লাহু আকবর বলবে।’ এই সহজ আমলটিই একজন দরিদ্র মুসলিমকে ধনীর হজ-সদকার সওয়াবের কাতারে পৌঁছে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এটি এমন একটি আধ্যাত্মিক মুদ্রা যা সব মানুষের নাগালের মধ্যে, যার জন্য প্রয়োজন শুধু একটু সময়।
এই জিকিরের একাধিক পদ্ধতি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেকোনো একটি পদ্ধতি অনুসরণ করলেই যথেষ্ট। প্রথম পদ্ধতি হলো ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবর—মোট ৯৯ বার বলা। এটি সহিহ বুখারিতে বর্ণিত মৌলিক পদ্ধতি।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলে মোট ১০০ বার পূর্ণ করা। এটি সহিহ মুসলিমে বর্ণিত। তৃতীয় পদ্ধতিতে ৩৩ বার করে তিনটি জিকিরের পর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির’ একবার পড়ে ১০০ পূর্ণ করা যায়, যা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ।
আরও পড়ুন: জিকির-দোয়ার কার্যকরী পদ্ধতি: কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক সম্পূর্ণ গাইড
চতুর্থ পদ্ধতি হিসাবে ২৫ বার করে চারটি জিকির—সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেও ১০০ পূর্ণ করা যায়। পঞ্চম ও সহজতম পদ্ধতি হলো নামাজের পর মাত্র ১০ বার করে তিনটি জিকির বলা, যা দিনে পাঁচ ওয়াক্তে ১৫০ বার হলে আল্লাহর দরবারে ১৫০০ নেকি হিসেবে গণ্য হয়।
এই জিকিরের মাহাত্ম্য শুধু নামাজের পরই সীমাবদ্ধ নয়। হজরত ফাতিমা (রা.)-এর গৃহস্থালির কাজের কষ্ট দেখে হজরত আলী (রা.) নবীজির কাছে একটি সেবক চাইলেন। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দেব যা একজন চাকরের চেয়েও উত্তম? যখন তোমরা ঘুমাতে যাবে, তখন ৩৪ বার আল্লাহু আকবার, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ এবং ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ বলবে।’ এই শিক্ষা প্রমাণ করে এই জিকির দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশীর্বাদ বয়ে আনে।
এই আমলটির বিশেষত্ব হলো এটি আধ্যাত্মিক সমতা প্রতিষ্ঠা করে। আল্লাহর দরবারে বাহ্যিক সম্পদ নয়, বরং আন্তরিক ইবাদতই মূল্যবান। এটি সময় ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার মাত্র দুই-তিন মিনিটের এই আমল হজ-সদকার সমপর্যায়ের সওয়াব এনে দেয়। হাদিসে এসেছে, এই আমলকারীর গুনাহ সমুদ্রের ফেনার মত বহুসংখ্যক হলেও ক্ষমা করা হয়। এটি ধনী-দরিদ্র সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে—দরিদ্রের জন্য বিশেষ অনুগ্রহ, ধনীর জন্য অতিরিক্ত পুরস্কার।
আরও পড়ুন: ইসমে আজমের মাধ্যমে দোয়া করার পদ্ধতি
নামাজের সালাম ফেরানোর পরপরই এই জিকির শুরু করা উত্তম। ডান হাতের আঙুলে গণনা করা সুন্নত পদ্ধতি। যদি ভুলে যায়, তবে যতদ্রুত সম্ভব আদায় করে নেওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ হলো নিয়মিততা ও একাগ্রতা। এই জিকির আমাদেরকে তিনটি মৌলিক শিক্ষা দেয়: তাওহিদের স্বীকৃতি (সুবহানাল্লাহ), শুকরিয়া (আলহামদুলিল্লাহ) এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা (আল্লাহু আকবর)।
যে সমাজে বাহ্যিক সম্পদকে মর্যাদার মাপকাঠি ধরা হয়, এই আমলটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহর কাছে প্রকৃত সম্পদ হলো জবানের জিকির ও ক্বলবের ইখলাস। নবীজির এই শিক্ষা প্রমাণ করে ইসলাম কখনোই সম্পদকে পুণ্যের একমাত্র মাপকাঠি করেনি। বরং আন্তরিকতা ও নিয়মিততাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুঁজি।
আজ থেকেই শুরু করুন এই সহজ অথচ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমলটি। এটি হতে পারে আপনার আধ্যাত্মিক জীবনে বিপ্লবের সূচনা—দুনিয়ার সীমাবদ্ধতা ও আখেরাতের অফুরন্ত নেয়ামতের মধ্যকার সেতুবন্ধন।
(বুখারি: ৮৪৩; ৬৩১৮; মুসলিম: ৪৯০৬; ৫৯৬; নাসায়ি: ১৩৫০; তিরিমিজি: ৩৪১০)