ধর্ম ডেস্ক
০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৬ পিএম
কোরআনুল কারিম মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ ও সর্বোত্তম পথনির্দেশক গ্রন্থ। এটি শুধুই একটি গ্রন্থ নয়—এটি সওয়াব, আলো, হেদায়েত ও আত্মার শান্তির উৎস। প্রতিটি মুসলিমের জন্য কোরআন শেখা ও সঠিক তেলাওয়াত অত্যন্ত জরুরি। তবে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে যে, শুদ্ধভাবে পড়তে না পারলে কোরআন পড়াই যেন নিষ্ফল। বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। যাদের তেলাওয়াত কঠিন, তাদের জন্যও আছে নবীজি (স.)-এর এক অনন্য সুসংবাদ- দ্বিগুণ প্রতিদান।
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যারা উত্তমরূপে কোরআন পড়বে তারা থাকবে অনুগত সম্মানিত ফিরিশতাদের সাথে। আর যে কোরআন পড়তে গিয়ে আটকে আটকে যায় এবং কষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব।’ (সহিহ মুসলিম: ৭৯৮)
এই হাদিসটি একটি মহান বার্তা বহন করে যে, কোরআন শিখতে মানুষের আগ্রহ, কষ্ট ও অধ্যবসায় আল্লাহর কাছে এতটাই মূল্যবান যে তা দক্ষ পাঠকের চেয়ে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী করে। এটি সেই সব ভাই-বোনদের জন্য অপার আশার বাণী যারা ভাষাগত জটিলতা, সময়াভাব বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে শুদ্ধ তেলাওয়াত শেখার সুযোগ পাননি।
আরও পড়ুন: প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত
হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (স.) কোরআন তেলাওয়াতের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে চার ধরনের মানুষের উদাহরণ দিয়েছেন- ‘যে মুমিন কোরআন তেলাওয়াত করে, সে সুগন্ধি ও সুমিষ্ট কমলালেবুর মতো। যে মুমিন তেলাওয়াত করে না, সে খেজুরের মতো; বাহ্যিক গন্ধ নেই কিন্তু ভেতরে মিষ্টি। যে মুনাফিক তেলাওয়াত করে, সে সুগন্ধি ফুলের মতো যার স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক তেলাওয়াতই করে না, সে তিক্ত হানযালাহ ফলসদৃশ (আরব মরুভূমির এক তিক্ত, অখাদ্য, করলা-সদৃশ ফল)।’ (সহিহ মুসলিম: ৭৯৭)
এই উপমার গভীর তাৎপর্য হলো- কোরআন তেলাওয়াত মুমিনের চরিত্রকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকে সুন্দর করে তার কথা, আচরণ ও অন্তরকে আলোকিত করে। এটি শুধু উচ্চারণের আমল নয়; এটি হৃদয় পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া।
রাসুল (স.) বলেছেন, ‘কোরআন ও রোজা কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে- ‘হে প্রভু, আমি দিনের বেলায় তাকে পানাহার থেকে বিরত রেখেছি।’ কোরআন বলবে- ‘আমি রাতের ঘুম থেকে তাকে বিরত রেখেছি।’ অতঃপর উভয়ের সুপারিশই গৃহীত হবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪)
এখানে কোরআনের সুপারিশের একটি অনন্য দিক ফুটে উঠেছে: কোরআন শুধু তার পাঠককে নয়, তার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মুহূর্তকে সাক্ষী দেবে। যে রাতগুলো তেলাওয়াত ও চর্চায় কাটানো হয়েছে, সেগুলোই কেয়ামতের দিন তার পক্ষে কথা বলবে।
আরও পড়ুন: বিনয়ের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত শোনার ফজিলত
নবীজি (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করে, তার জন্য একটি নেকি আছে। আর প্রতিটি নেকি দশ গুণ বৃদ্ধি পায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আলিফ-লাম-মিম একটি হরফ নয়; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ ও মিম একটি হরফ।’ (সুনানে তিরমিজি: ২৯১০)
এই হিসাবের তাৎপর্য অপরিসীম। যে ব্যক্তি আটকে আটকে সুরা ইখলাস পড়েন, তার প্রতিটি সংগ্রামী হরফের জন্য রয়েছে দশ নেকি। আর যেহেতু কষ্ট করে পড়ার কারণে তার সওয়াব দ্বিগুণ হয়, তাই প্রকৃতপক্ষে তার একটি হরফের সওয়াব হয়ে দাঁড়ায় বিশ নেকির সমতুল্য।
ইসলামি শরিয়তে নামাজের কিরাতের শুদ্ধতা ফরজ পর্যায়ের গুরুত্ব বহন করে। ফিকহের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে- ‘লাহনি জলি’ অর্থাৎ এমন ভুল যা শব্দের অর্থই পরিবর্তন করে দেয়, তা নামাজ ভঙ্গকারী। (খুলাসাতুল ফতোয়া: ১/১১৮) অন্যদিকে, ‘লাহনি খফি’ বা ছোটখাটো উচ্চারণগত ভুল নামাজ ভঙ্গ না করলেও এড়িয়ে চলা ওয়াজিব।
প্রতিটি মুসলিমের জন্য অন্তত নামাজে আবশ্যক সুরাগুলো শুদ্ধভাবে শেখা ফরজ। মুকাদ্দামায়ে জাজারিয়ার ব্যাখ্যায় এসেছে- ‘প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নিজে ও পরিবারের সদস্যদের কোরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ করার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া।’ (পৃ. ১১)
আরও পড়ুন: কোরআনের শুধু অনুবাদ পড়লে সওয়াব পাওয়া যাবে?
সাহাবায়ে কেরাম নবীজি (স.)-এর কিরাতকে অত্যন্ত সুষম ও সুস্পষ্ট বলে বর্ণনা করেছেন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (স.) তেলাওয়াত করতেন দীর্ঘায়িত করে, প্রতিটি শব্দকে তার প্রাপ্য হক দিয়ে। তিনি ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ পাঠ করতেন যেন শব্দগুলোর মধ্যে ব্যবধান ও মাধুর্য ফুটে উঠে। (সহিহ বুখারি: ৫০৪৬)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর বর্ণনা আরো চমকপ্রদ- ‘রাসুলুল্লাহ (স.) আমার হাত তাঁর উভয় হাতের মধ্যে রেখে তাশাহুদ আমাকে এমনভাবে শিখিয়েছেন, যেভাবে তিনি কোরআনের সুরা শেখাতেন।’ (সহিহ বুখারি: ৬২৬৫) এটি প্রমাণ করে, কোরআন শিক্ষা ছিল নবীজির কাছে একটি পবিত্র ও সযত্ন প্রক্রিয়া।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘ইহা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি, তুমি সেই পাঠের অনুসরণ করো। অতঃপর এর ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্বও আমার।’ (সুরা কিয়ামাহ: ১৭-১৯)
এই আয়াত থেকে আমরা পাই একটি মৌলিক দিকনির্দেশনা: কোরআনের শুদ্ধ উচ্চারণ ও পাঠ রক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর। তাই কোরআন শেখার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা কেবল একটি ভাষা শিখছি না; বরং আল্লাহ কর্তৃক সংরক্ষিত একটি ঐশী ধারা অনুসরণ করছি।
প্রথমে হতাশ হবেন না। যারা সম্পূর্ণ নতুন, তারা একটি ছোট সুরা দিয়ে শুরু করুন—যেমন সুরা ফাতিহা বা সুরা ইখলাস। অভিজ্ঞ ক্বারি বা হাফেজের তত্ত্বাবধানে মাখরাজ (উচ্চারণ স্থান) ও তাজবিদের মূল নিয়মগুলো শিখুন। প্রতিদিন নিয়মিত ১৫-২০ মিনিট অনুশীলন করুন। আজকাল অনেক বিশ্বস্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বিনামূল্যে কোরআন শিক্ষার সুযোগ রয়েছে।
যারা নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন, তারা আল্লাহর বিশেষ বান্দা। আর যারা আটকে আটকে, কষ্ট করে তবুও পড়ার চেষ্টা চালিয়ে যান, তারা সেই মর্যাদার পাশাপাশি পান দ্বিগুণ সওয়াবের অতিরিক্ত পুরস্কার। তাই কোরআনে অদক্ষ বা নতুন হওয়া কখনও হতাশার কারণ নয়; বরং এটি একটি অনন্য সুযোগ; আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভের মহা মাধ্যম। আসুন, আমরা আজই প্রতিজ্ঞা করি- ‘আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমার প্রতিটি আটকানো হরফ যেন দ্বিগুণ সওয়াবের সাক্ষী হয়।’