ধর্ম ডেস্ক
০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৫ পিএম
ইসলামে সুদ (রিবা) সম্পূর্ণ হারাম এবং গুনাহে কবিরা। কোরআন, হাদিসের সুস্পষ্ট দলিলে সুদকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরির সেলারি অ্যাকাউন্ট, ব্যাংকিং বাধ্যবাধকতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক মুসলিম অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্যাংকে টাকা রাখতে বাধ্য হন। ফলে তাদের অ্যাকাউন্টে সুদের টাকা জমা হয়। এই অবস্থায় সুদের টাকা শরিয়তসম্মতভাবে কীভাবে খরচ করতে হবে, তার পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন- ‘আল্লাহ বেচাকেনা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫) ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও। অতঃপর যদি তোমরা না কর তবে আল্লাহ ও তার রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও।’ (সুরা বাকারা: ২৭৮-২৭৯) ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাকে বৃদ্ধি করেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭৬)
রাসুলুল্লাহ (স.) সুদের সাথে জড়িত সকল পক্ষকে অভিশাপ দিয়েছেন- ‘সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক এবং এর সাক্ষী—তাদের সকলকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই সমান (অপরাধী)।’ (মুসনাদে আহমদ: ৩৮০৯; সহিহ মুসলিম: ১৫৯৮)
আরও পড়ুন: সুদ খাওয়ার শাস্তি কী?
সুদি ব্যাংকে স্বেচ্ছায় সঞ্চয়ী বা মেয়াদী হিসাব খোলা হারাম। কারণ এতে সুদের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়, যা ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ গ্রহণের শামিল। ফিকহি গ্রন্থ ‘ফাতাওয়া উসমানি’ (৩/২৬৯) ও ‘কিফায়াতুল মুফতি’ (৭/১০৫)-এ বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট বিধান বর্ণিত হয়েছে।
এমনকি যদি কারও নিয়ত হয় যে ‘সুদ নিয়ে পরে তা গরিবদের দান করে দেব’, তবুও ইচ্ছাকৃতভাবে সুদি হিসাব খোলা জায়েজ নয়।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া বর্তমান সময়ের সাধারণ প্রথা। এই সেলারি অ্যাকাউন্ট থেকে সুদ জমা হলে করণীয় হলো:
১. বেতন পাওয়া মাত্র উত্তোলন: মাসিক বেতন অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার পর তা দ্রুত তুলে নেওয়া উত্তম।
২. সুদ আলাদা করা: বছর শেষে সুদ জমা হলে তা মূল টাকা থেকে আলাদা করতে হবে।
৩. সুদের ব্যবস্থাপনা: এই সুদ সওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরিব-মিসকিনকে দান করে দিতে হবে।
‘আহসানুল ফাতাওয়া’ (৭/১৬) গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, সুদের টাকা ব্যাংকে ফেলে রাখা যাবে না, কারণ পরবর্তীতে এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হতে পারে এবং কোথায় ব্যয় হবে তা অনিশ্চিত।
আরও পড়ুন: সবচেয়ে জঘন্য ৭ গুনাহ
এই বিষয়ে আলেমদের মূলত দুটি মত পাওয়া যায়:
প্রথম মত (দুর্বল মত) সুদ না তুলে ব্যাংকেই রেখে দেওয়া: কেউ কেউ মত দেন যে, সুদ হাতে না নিয়ে ব্যাংকেই রেখে দেওয়া উচিত। তাদের যুক্তি হলো, সুদ হাতে নেওয়াই গুনাহ, তাই এড়িয়ে চলাই ভালো। তবে অধিকাংশ মুফতি এই মত গ্রহণ করেননি।
দ্বিতীয় মত (অগ্রগণ্য ও বিশুদ্ধ মত) সুদ তুলে সওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরিবদের দেওয়া: ফিকহের বিশুদ্ধ মত হলো- সুদের অর্থ তুলে সওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরিব-মিসকিনকে দান করে দেওয়া। ফিকহ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘অ্যাকাউন্টে সুদ জমা হওয়ার অর্থই হলো তা হস্তগত হওয়া। যেহেতু মূল সুদদাতা অসংখ্য এবং অজ্ঞাত, তাই এটি ‘মালে লুকাতা’ (হারানো মাল)-এর বিধানের অন্তর্ভুক্ত। হারানো মালের বিধান হলো তা দরিদ্রদের দান করে দেওয়া।’ (তাফসিরে কুরতুবি: ৩/২২৫, ২৩৭; বজলুল মাজহুদ: ১/৩৭; মাআরিফুস সুনান: ১/৩৪) ‘ফাতাওয়া উসমানি’ (৩/২৬৯) ও ‘কিফায়াতুল মুফতি’ (৭/১০৫) গ্রন্থেও এ মতটিকেই অগ্রগণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ব্যাংক ঋণ জায়েজ হওয়ার ৮ শর্ত
তবে লক্ষণীয় যে, এই দান থেকে দাতার কোনো সওয়াব হবে না; শুধু গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ হবে।
যদি কোনো তালিবুল ইলম প্রকৃতই গরিব হয়, তাহলে তাকে সুদের অর্থ দেওয়া ফিকহি দৃষ্টিতে জায়েজ আছে। তবে আদব ও নৈতিক বিবেচনায় ‘তালিবুল ইলম আল্লাহর দরবারে সম্মানিত, তাই তাকে সুদের মতো অপবিত্র মাল দ্বারা সাহায্য করার চেয়ে হালাল মাল দ্বারা সাহায্য করা উত্তম।’
ইসলামের নির্দেশনা স্পষ্ট: সুদ সম্পূর্ণ হারাম। এটি ভোগ করা, উপকারে লাগানো বা পবিত্র কাজে ব্যবহার করা কোনোভাবেই জায়েজ নয়। যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে সুদের টাকা হাতে আসে (যেমন সেলারি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে), তবে শরিয়তের বিধান হলো তা সওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরিব-অসহায় মানুষকে দান করে দেওয়া। এটাই কোরআন-সুন্নাহ, ফিকহের চার মাজহাব ও সমকালীন মুফতিদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত।