ধর্ম ডেস্ক
০৩ জুলাই ২০২২, ০৪:৫৩ পিএম
বর্তমান সমাজে সেলফি একটি রোগের মতো হয়ে গেছে। মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে এ সেলফির ব্যবহার। অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মহান ইবাদত হজে গিয়েও সেলফির ব্যবহার করছেন অনেক হজযাত্রী। ইহরাম বাঁধার স্থান (মিকাত) থেকে শুরু করে বিমানে, ইহরামে, বায়তুল্লাহ তাওয়াফে, জমজমের পানি পানে, সাফা-মারওয়া সায়িতে, আরাফাতের ময়দানে, মিনার কঙ্কর নিক্ষেপে এমনকি মাথামুণ্ডনেও সেলফি তুলে তা ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের হিড়িক চলছে।
অথচ সেলফি তোলার মূল উদ্দেশ্যই হলো আত্মপ্রদর্শন। যাকে শরিয়তের ভাষায় ‘রিয়া’ বলা হয়। হজের মতো আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ ইবাদতে এহেন হীন কাজের পরিণতি হতে পারে খুবই ভয়াবহ। ভুলে গেলে চলবে না, ঈমানকে ধ্বংস করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এই সেলফি। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘সামান্যতম রিয়াও (লোক দেখানো আমল) শিরক’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৯৮৯)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি লোক দেখানো ইবাদত করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোক দেখানো উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪৯৯)
মিকাতে পৌঁছা থেকে শুরু করে হজের কার্যক্রমে হজের প্রত্যেকটি রুকনে সকল আত্মগরিমা, আত্মপ্রদর্শনেচ্ছা পরিত্যাগ করে তাসবিহ, দোয়া, জিকির-আজকার এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন প্রিয়নবী (স.)। এ থেকে বুঝা যায় বর্তমান সেলফি তোলা ও ভিডিও করা বিশ্বনবীর (স.) হাদিসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যেখানে মানুষ শুধু আল্লাহকে পেতেই যায়, সেখানে লাইক-কমেন্ট পেতে মরিয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কেউ মসজিদে বসে, কেউ নামাজের মতো অঙ্গভঙ্গি করে সেলফি তুলছেন!
অথচ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; পুণ্যবান তো সে-ই, যে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে, ঈমান এনেছে শেষ দিবসের ওপর এবং সব ফেরেশতা, কিতাবসমূহ ও নবীগণের ওপর’ (সুরা বাকারা: ১৭৭)।
এ আয়াতে গভীর শিক্ষা রয়েছে প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য। খুব সচেতন থাকতে হবে—ইবাদত যেন শুধু অঙ্গভঙ্গিতে রূপান্তরিত না হয়। প্রতিটি আমলই যেন শুধু আল্লাহর জন্য হয়। মানুষকে দেখানোর কোনো প্রবণতা থাকবে না সেখানে। কারণ আল্লাহ আমাদের অন্তর দেখেন। সেজন্যই মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তার (কোরবানির প্রাণীর) গোশত ও রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া...’ (সুরা হজ: ৩৭)। সুতরাং হজের সময় হাজিদের সেলফি তোলা থেকে বিরত থাকাই আবশ্যক।
মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হজের আহকামগুলো ইখলাসের সঙ্গে যথাযথ আদায় করতে হয়। লোক দেখানো যে কোনো ধরনে কার্যক্রমই ইবাদত-বন্দেগির চেতনাকে বিনষ্ট করে দেয়। সেলফির কার্যক্রম, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ইবাদতের অন্তরায়। মুমিন হৃদয়ের একনিষ্ঠতায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটায় এই সেলফি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যেকোনো রকম আত্মপ্রদর্শনে মুমিনের বড় সম্পদ তাকওয়া অর্জন হয় না। তাই নিজেকে প্রদর্শনের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে হবে।
তাই হজে যাওয়ার আগে নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে হবে। তা না হলে সেলফির মতো অযথা কাজ থেকে বাঁচা যাবে না, কোনো প্রতিফলও পাওয়া যাবে না। মক্কা-মদিনায় শুধু ঘুরে আসা হবে। নবীজি (স.) বলেছেন, প্রত্যেক কাজের ফলাফল নিয়ত অনুসারে হয়। প্রত্যেক মানুষ তার কাজের ফলাফল আল্লাহর কাছে তদ্রূপ পাবে, যেরূপ সে নিয়ত করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, সে অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পার্থিব ফায়দা হাসিল করার অথবা কোনো রমণীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, সে তার ফল তা-ই পাবে, যা সে নিয়ত করেছে।’ (সহিহ বুখারি: ১)
হজের সকল রুকন সঠিকভাবে পালন করা জরুরি। যদি তা যথাযথ পালনে বিঘ্ন ঘটে, দম তথা কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়। যা না করলে হজ সম্পন্ন হবে না। সেখানে সেলফি তুলে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি অন্যের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো দুইটি গুরুতর অপরাধ। পবিত্র কোরআন হাদিস ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে, পৃথিবীর সব ইমাম ফকিহ ও ধর্ম বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, অতি প্রয়োজন ছাড়া ছবি তোলা আঁকা ও প্রকাশ করারও অনুমতি ইসলাম দেয়নি। সেখানে কাবার আঙিনায় সেলফি তোলা স্পষ্টভাবে পবিত্র কাবার সঙ্গে বেয়াদবি। সরাসরি আল্লাহর হুকুমের সীমালঙ্ঘন।
উল্লেখ্য, মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববিতে সেলফি তোলা নিষেধ। এ ব্যাপারে ২০১৭ সালে প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তারপরও হজ ও ওমরা করতে গিয়ে অনেকে গোপনে সেলফি তোলেন। এ জন্য বিভিন্ন সময় বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষকে। সুতরাং হজের সময় যে কোনো ধরনের ছবি তোলা বা ভিডিও করা থেকে বিরত থাকুন। হজের কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশ করুন। আল্লাহ তাওফিক দিন। আমিন।