ধর্ম ডেস্ক
৩০ জুন ২০২২, ০৩:৩১ পিএম
পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার এক বিস্ময়কর নিদর্শনের নাম জমজম কূপ। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পবিত্র কাবা ঘরের পাশে এক শিশুর পায়ের আঘাতে কূপটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। শিশুটি ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)। বরকতময় এ কূপের পানি বিশুদ্ধতায় অতুলনীয়। প্রতি সেকেন্ডে আট হাজার লিটার পানি উত্তোলন করার পরও এ কূপ থেকে পানি কখনও কমে যায়নি।
কূপটি কাবা থেকে ২০ মিটার বা ৬৬ ফুট পূর্বে অবস্থিত। মসজিদে হারামের ভেতরেই এই কূপের অবস্থান। এটি প্রায় ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট চওড়া একটি আয়তক্ষেত্রের মতো। এর গভীরতা ৩০ মিটার বা ৯৮ ফুট। মতান্তরে ১২০ বা ১৪০ ফুট। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে এই কূপের ছিলো দুটি জলাধার। একটি খাওয়ার জন্য। অন্যটি অজু করার জন্য। বর্তমানে বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে পানি উঠানো হয়।
তখন ছিলো হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নবুয়তকাল। মহান আল্লাহ একের পর এক কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছেন তাঁর, আর ইবরাহিম (আ.)-ও খুব সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হচ্ছেন। হজরত ইসমাইল (আ.)-এর জন্মের কিছুদিন পর আরেক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন ইবরাহিম (আ.)। নির্দেশ আসে, প্রিয় সন্তান ও স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে মক্কার জনশূন্য মরুপ্রান্তরে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। আল্লাহর নির্দেশ পালনে তিনি তাদেরকে আরবের এক জনশূন্য প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। ধু ধু মরীচিকাময় এক ভীতিপ্রদ উপত্যকা। এমন অঞ্চলে বাস করা একজন নারীর জন্য খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো। এই নিদারুণ পরিস্থিতিতে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মনটা ডুকরে কেঁদে উঠেছিলো।
বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় যখন তিনি (হাজুনের কাছে) সানিয়্যাহ নামক স্থানে এসে পৌঁছলেন, তখন তিনি কাবাঘরের দিকে মুখ করে দুহাত তুলে এই দোয়া করলেন, ‘হে প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরকে ফল-ফসলহীন উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের কাছে বসবাস করালাম; যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। সুতরাং তুমি কিছু লোকের অন্তরকে ওদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলাদি দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করো; যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’ (সুরা ইবরাহিম: ৩৭)
তপ্ত বালুচরে একসময় মা হাজেরা ও শিশু ইসমাইলের খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে গেলো। মা হাজেরার বুকের দুধ শুকিয়ে গেলে পিপাসার্ত হয়ে পড়ে শিশু ইসমাইল। ছেলের করুণ অবস্থা দেখে দিশাহারা হয়ে পড়লেন মা হাজেরা। এক ফোঁটা পানির আশায় এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। সাফা পাহাড়ের মরীচিকাকে পানির নহর মনে করে দৌড়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু দেখলেন, তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া কিছুই নেই। একই আশা নিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে গেলেন মারওয়া পাহাড়ে, সেখানেও পানি নেই। এভাবে সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফায় সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন। দৌড়াদৌড়ির সপ্তম বা শেষ বার তিনি লক্ষ্য করলেন, শিশু ইসমাইলের পায়ের নিচে পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।
দ্রুত শিশু ইসমাইলের কাছে ছুটে আসেন তিনি। শিশুকে কোলে তুলে নিলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এরপর শিশুকে পানি পান করালেন; নিজেও পান করলেন। পানির ফোয়ারা ক্রমশ উথলে উঠছে ও প্রবাহিত হতে চাচ্ছে। হাজেরা (আ.) খুব আনন্দিত হলেন এবং চারদিকে পাড় বেঁধে পানি থামানোর চেষ্টা করলেন। তিনি পানিকে থামার নির্দেশ দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলছিলেন ‘জমজম’ অর্থাৎ থেমে যাও। আল্লাহর ইচ্ছায় তা নির্দিষ্ট স্থানে থেমে গেলো। হজরত হাজেরার উচ্চারিত সেই হিব্রু শব্দেই এ কূপের নাম হয়ে যায় ‘জমজম’।
এই কূপের নামকরণ নিয়ে আরবের কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন, ‘জমজম’ অর্থ অধিক হওয়া। এখানে পানির আধিক্যের কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘জমজম’। বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত জিব্রাইল (আ.)-এর পা অথবা ডানার আঘাতে সৃষ্টি হয়েছিল এই পবিত্র ‘জমজম’।
পানির সুবিধা দেখে ইয়েমেনের জুরহাম গোত্রের কিছু লোক সেখানে বসতি স্থাপন করলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জনমানবহীন মরুপ্রান্তর রূপ নিলো জনবসতিতে। ইসমাইল (আ.) বড় হয়ে এই গোত্রে বিয়ে করেন। তাঁরাই কাবা ঘরের খাদেম হন। পৌত্তলিক যুগে জুরহাম গোত্র মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়। ক্ষমতা দখল করে খোজায়া গোত্র। চলে যাওয়ার আগে জুরহাম গোত্রের লোকেরা কুয়াটি মাটি দিয়ে ভরাট করে দেয়। সাড়ে ৪০০ বছর এভাবেই পড়ে থাকে জমজম কূপ। ৫৭০ সালে আবদুল মুত্তালিব স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে ছেলে হারেসকে সঙ্গে নিয়ে জমজম কূপ খনন করেন এবং হাজিদের পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেন।
পরে জমজম কূপ আরও বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়। প্রথমে এটি বালি ও পাথর দিয়ে ঘেরা অবস্থায় ছিলো। পরবর্তীতে খলিফা আল মনসুরের সময় ৭৭১ সালে এর উপর গম্বুজ এবং মার্বেল টাইলস বসানো হয়। ৭৭৫ সালে খলিফা আল মাহদি এটি আরো সংস্কার করেন। তিনি সেগুন কাঠের আরেকটি গম্বুজ নির্মাণ করেন। ৮৩৫ সালে খলিফা মুতাসিম গম্বুজটি মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মাণ করেন। ১৪১৭ সালে মামলুকদের আমলে গম্বুজটি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। ১৯১৫ সালে অটোমান সুলতান আবদুল হামিদ সেটির আধুনিকায়ন করেন।
সর্বশেষ ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে সংস্কার করেন সৌদি বাদশাহ। বাদশাহ আবদুল আজিজ বিন সউদের সময় জমজমের দক্ষিণ দিকে ৬টি এবং পূর্বদিকে ৩টি টেপ লাগানো হয়। বর্তমানে জমজম কূপ ভূগর্ভস্থ অবস্থায় রাখা হয়েছে। এখান থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হয় এবং মসজিদুল হারামের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ করা হয়।
সৌদি আরবের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বোর্ডর অধীনে জমজম কূপের ওপর একটি গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, জমজমের পানির স্তর ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১০ দশমিক ৬ ফুট নিচে। ভারী মোটরের সাহায্যে প্রতিসেকেন্ডে ক্রমাগত ৮হাজার লিটার হারে ২৪ঘণ্টার বেশি সময় পাম্প করা হয়। তখন পানির পর্যায় ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৪৪ ফুট নিচে নামলেও পাম্প বন্ধ করার মাত্র ১১ মিনিটে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
জমজমের পানির স্বাদ পরিবর্তন হয় না। জন্মায় না কোনও ছত্রাক বা শৈবাল। সৃষ্টির পর থেকে একই রকম রয়েছে এর পানিপ্রবাহ। হজ মওসুমে পানির ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও পানির স্তর কখনও নিচে নামে না। কখনও পানির স্বল্পতা দেখা যায়নি জমজম কূপে। সৃষ্টির পর থেকে এর গুণাগুণ ও বিভিন্ন উপাদান একই পরিমাণে আছে। এ কূপের পানিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সল্টের পরিমাণ সাধারণ পানির তুলনায় বেশি। এজন্য এই পানি শুধু পিপাসা মেটায় না, ক্ষুধাও নিবারণ করে। জমজমের পানিতে ফ্লুরাইডের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে কোনও জীবাণু জন্মায় না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। এই পানি পান করলে ক্লান্তি দূর হয়। জমজমের পানি পৃথিবীর উন্নত মানসম্পন্ন ল্যাবে পরীক্ষা করেও কোনও দূষণ পাওয়া যায়নি।
জাপানের বিখ্যাত গবেষক মাসারু ইমোতো বলেন, জমজমের এক ফোঁটা পানির যে নিজস্ব খনিজ গুণাগুণ আছে, তা পৃথিবীর অন্য পানিতে নেই। তিনি আরো বলেন, সাধারণ পানির এক হাজার ফোঁটার সাথে যদি জমজমের পানির এক ফোঁটা মেশানো হয়, সেই মিশ্রণও জমজমের পানির মতো বিশুদ্ধ হয়ে যায়। জমজমের পানির অণুগুলো অন্য পানির তুলনায় সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ। এই পানিতে প্রচুর নিরাময় শক্তি রয়েছে।
প্রসিদ্ধ মুফাসসির আল্লামা ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন, ৪৮৯ হিজরির জিলহজ মাসে আমি মক্কায় অবস্থান করছিলাম। আমি খুব বেশি করে জমজমের পানি পান করতাম। প্রতিবার পানের সময় আমি ইলম ও ঈমানের নিয়ত করতাম। ফলে আল্লাহ তাআলা এর বরকত আমাকে দান করেন এবং আমি যথাসাধ্য ইলম হাসিল করলাম। কিন্তু আমলের নিয়তে জমজমের পানি পান করতে ভুলে গেলাম। হায়! যদি আমলের নিয়তেও পান করতাম, তবে আল্লাহ আমাকে ইলম ও আমল উভয়টির বরকত নসিব করতেন। কিন্তু তা হলো না। (আহকামুল কোরআন: ৩/৯৮)
হাদিসশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে খুজায়মা (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, এত ইলম আপনি কিভাবে অর্জন করলেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘জমজমের পানি যে নিয়তে পান করা হয় তা-ই কবুল হয়।’ আর আমি যখন জমজমের পানি পান করেছিলাম, তখন আল্লাহর কাছে উপকারী ইলম প্রার্থনা করেছিলাম’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১৪/৩৭০)। সহিহ হাদিসে বিধৃত হয়েছে যে, নবীজি (স.) নিজে জমজম থেকে পানি পান করেছেন। (সহিহ বুখারি: ১৫৫৬)
হজরত আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি বরকতময়, স্বাদ অন্বেষণকারীর খাদ্য’ (সহিহ মুসলিম: ২৪৭৩)। জাবির (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩০৬২)
প্রিয়নবী (স.) প্রায় দেড় হাজার বছর আগে যা বলেছেন, সেটাই আজ বাস্তবতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাভাবিক পানিতে আর্সেনিকের গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম। যদি পানিতে এই মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাহলে তা কিডনি ও লিভারের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি হতে পারে ক্যানসারের কারণ। জমজমের পানিতে আর্সেনিক সেই অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম।
এই কূপের পানি বণ্টনের জন্য ১৪০৩ হিজরিতে সৌদি বাদশাহের এক রাজকীয় ফরমান অনুযায়ী হজ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইউনিফাইড ‘জামাজেমা দফতর’ গঠিত হয়। এই দফতরে একজন প্রেসিডেন্ট ও একজন ভাইস প্রেসিডেন্টসহ মোট ১১ জন সদস্য ও ৫ শতাধিক শ্রমিক ও কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। তারা এই কূপের পানির মান, গভীরতা, অম্লতার মাত্রা এবং তাপমাত্রার দিকে নজর রাখেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পানি রপ্তানী ও অবৈধ বিক্রয় নিষিদ্ধ।