ধর্ম ডেস্ক
৩০ জুন ২০২২, ০৯:০৪ এএম
কাবা আল্লাহর ঘর। বিশ্বমুসলিমের সম্মিলনস্থল। প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মুসলমানরা আল্লাহর নির্দেশ পালনে হজব্রতের উদ্দেশে এখানে এসে উপস্থিত হন। সৌদি আরবের মক্কা মুকাররমার মসজিদুল হারামে অবস্থিত পবিত্র কাবাঘর। ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান, যা পৃথিবীর নাভি হিসেবে বিবেচিত। এটি মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র ও সম্মানের স্থান এবং নামাজের কেবলা।
কাবা শব্দের অর্থ উঁচু। আরবিতে উঁচু ঘরকে কাবা বলা হয়। এই ঘরটি যেহেতু উঁচু তাই এর নামকরণ করা হয়েছে কাবা। অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কাফ-আইন-বা এই তিনটি মূল অক্ষর নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘কাব’ বা ‘মুকাআব’ শব্দ, যার অর্থ চার কোণবিশিষ্ট। যেহেতু কাবাঘর চার কোণবিশিষ্ট তাই এর নামকরণ এভাবেই হয়েছে। কাবাকে আরও চার নামে যেমন আল বাইত, বাইতুল আতিক, মসজিদুল হারাম এবং বাইতুল মুহাররাম নামেও অভিহিত করা হয়।
কাবাঘরের আয়তন পশ্চিমে ১০ দশমিক ১৫ মিটার (২২ হাত), পূর্বে ৮ দশমিক ৪০ মিটার (১৮ দশমিক ৫ হাত), দক্ষিণে ৮ দশমিক ২৪ মিটার (১৮ হাত), উত্তরে ৫ দশমিক ৫০ মিটার (১২ হাত) এবং উচ্চতা ৮ দশমিক ২৪ মিটার (১৮ হাত)। ভেতরে প্রবেশ করার জন্য একটিমাত্র দরজা রয়েছে যা বছরে তিনবার খোলা হয় অভ্যন্তরভাগ পরিষ্কার করার জন্য।
কখন নির্মিত হয়েছিল কাবা—এ নিয়ে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী, মহান আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারাই সর্বপ্রথম কাবাঘরের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছিলেন। বায়তুল মামুরের ঠিক নিচে কাবাকে স্থাপন করা হয়। পৃথিবীর সূচনা হয় কাবাঘর নির্মাণের মাধ্যমে। কোরআনের ভাষায়, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটিই হচ্ছে এই ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা নগরীতে) অবস্থিত।’ (সূরা ইমরান: ৯৬)।
কাবার উপরে ৭ম আকাশে অবস্থিত ফেরেশতাদের কাবাকে বলা হয় বায়তুল মামুর। এটি দুনিয়ার কাবার ঠিক উপরে। এখানে ফেরেশতারা নামাজ পড়েন এবং তাওয়াফ করেন। তাফসিরে ইবনে কাসিরের বর্ণনামতে, বায়তুল মামুর কাবাঘরের এতই সোজাসুজি যে, যদি ভেঙে পড়ে যায় তাহলে কাবা ঘরের উপরেই পড়বে। এরপর আদিমানব হজরত আদম (আ.) কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ করেন।
হজরত নূহ (আ.)-এর সময়ে মহাপ্লাবণে কাবাঘর প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তখন আল্লাহ তাআলা ওহির মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে কাবার স্থান দেখিয়ে দেন এবং পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। নির্দেশমতো হজরত ইব্রাহিম (আ.) ছেলে ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর পুনর্নিমাণ করেন। এক বর্ণনায় এসেছে, একটি মেঘখণ্ড বায়তুল্লাহ শরিফের স্থানে ছায়া ফেলে, যা দেখে দেখে হজরত ইবরাহিম (আ.) সে ছায়ার পরিমাপ মতো বর্তমান পবিত্র বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেন। এরপর হজরত জিব্রাইল (আ.) জান্নাত থেকে হাজরে আসওয়াদ পাথর নিয়ে এসে এটিকে কাবাঘরে স্থাপনের নির্দেশ দেন। কাবা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইবরাহিম (আ.)-কে হজের জন্য আহবান করতে আদেশ দেওয়া হয়।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর মাধ্যমে কাবা পুনর্নির্মাণের ৩০ বছর পর এক মহিলা কাবাঘরে সুগন্ধি দানকালে আগর বাতির ধোঁয়া থেকে সৃষ্টি হওয়া অগ্নিকাণ্ডে কাবাঘরের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। তাই কুরাইশরা কাবাঘরের সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক স্থাপিত ভিত্তির কিছুটা পরিবর্তন সাধন করেন।
কালক্রমে কাবাঘরে পৌত্তলিকতার চর্চা শুরু হয়। মক্কা বিজয়ের আগে এখানে ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল। পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের পর হজরত মুহাম্মদ (স.) কাবাঘর থেকে সব মূর্তি অপসারণ করেন। এরপর জিয়ারতকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মসজিদুল হারামের সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন। ফলে মাতাফ ও তাওয়াফের স্থান সম্প্রসারিত হয়।
ইতিহাসে সর্বপ্রথম নির্মাণ থেকে সর্বশেষ সময় পর্যন্ত মোট ১২ বার কাবাঘরের সংস্কার ও সম্প্রসারণ কাজের উল্লেখ আছে। ক্রমানুসারে তা হলো—
প্রথমে ফেরেশতাদের মাধ্যমে নির্মাণ। এরপর পুনর্নির্মাণ করেন যথাক্রমে হজরত আদম (আ.), হজরত শীষ (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.), আমালিকা সম্প্রদায়, জুরহাম সম্প্রদায়, কুসাই বিন কিলাব, মোযার সম্প্রদায়, কুরাইশগণকে নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এসময় তিনি হাজরে আসওয়াদকে বর্তমান স্থানে স্থাপন করেছিলেন।
এরপর ৬৪ হিজরিতে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.), ৭৪ হিজরিতে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এবং ১২তম বার ১০৪০ হিজরিতে ওসমানিয়া খলিফা চতুর্থ মুরাদ। এটাই আজ পর্যন্ত কাবাঘরের সর্বশেষ সংস্কার কাজ। এরপর ছোটখাট সংস্কার ছাড়া কেউ কাবাঘরে হাত দেয়নি।
ওসমানিয়া খেলাফতের সময় কাবাঘরে সর্বপ্রথম রৌপ্য নির্মিত কারুকার্যময় দরজা লাগানো হয়। বর্তমানে পবিত্র কাবাঘরের দরজাটি ২৮০ কেজি খাঁটি সোনা দ্বারা তৈরি করেন প্রয়াত সৌদি বাদশা খালিদ বিন আব্দুল আজিজ। দরজাটি তৈরি করতে মোট ব্যয় হয়েছে ১৩.৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কাবাঘরের মেঝে মূল্যবান মার্বেল টাইলস দিয়ে তৈরি। ভেতরের চারপাশের দেয়ালগুলো মেঝে থেকে উপরে চার মিটার পর্যন্ত কারুকার্যময় মার্বেল টাইলস দ্বারা মোড়ানো।
তার উপর থেকে ছাদ পর্যন্ত বাকি পাঁচ মিটার দেয়াল কাবার প্রাচীন গিলাফ দিয়ে মোড়ানো। এই গিলাফটিতে রুপোর ক্যালিওগ্রাফি আঁকা। ২০ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে প্রতি বছর নতুন করে গিলাফ তৈরি করা হয়। প্রত্যেক বছর হজের দিন ৯ জিলহজ ফজরের পরপরই পরানো হয় নতুন গিলাফ। সতর্কতামূলকসহ মোট দুইটি করে গিলাফ তৈরি করা হয়। এ গিলাফগুলো হাতে তৈরিতে সময় লাগে মোট আট থেকে নয় মাস। অন্যটি মেশিনে মাত্র এক মাসে তৈরি করা হয়। মক্কার উম্মুদ জুদ নামক এলাকার বিশেষ কারখানায় তৈরি হয় গিলাফগুলো।
মেঝের সাদা মার্বেলের মাঝে একটি গাঢ় সবুজ রং-এর টাইলস দিয়ে মহানবী (স.)-এর নামাজ ও সেজদার স্থান চিহ্নিত করে রাখা আছে। একই সবুজ টাইলস দিয়ে দরজার পাশে মূলতাজিমেও একটি স্থান নির্দিষ্ট করা আছে। নবীজি (স.) এখানে ডান গাল ও পেট ঠেকিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে দোয়া করতেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবায়ে কেরামের মতে, আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়ার আকুতি ও পাওয়ার আনন্দে নবীজি (স.) সেদিন এত বেশি কেঁদেছিলেন যে, উনার দাঁড়ি মোবারক, বুক ও পেট ভিজে গিয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকে হজরে আসওয়াদ ও দরজার মধ্যবর্তী স্থানটি মুলতাজিম বা দোয়া কবুলের স্থান হিসেবে স্বীকৃত।
প্রতি বছর হজের মওসুমের পূর্বে পবিত্র কাবাঘরের অভ্যন্তরভাগে জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করার পর অতি মূল্যবান সুগন্ধি মেশক আম্বর ও উদ ছিঁটানো হয়। সৌদি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মক্কার সম্মানিত গভর্নরের নেতৃত্বে হারামাইনের ইমাম ও মুয়াজজিনের অংশগ্রহণে এই পুরো কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। মাঝে মাঝে সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণও এই মহতি কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
পবিত্র কাবাঘরের বাইরের দিকের পূর্ব-দক্ষিণ কোণের দেয়ালে স্থাপিত রয়েছে হাজরে আসওয়াদ। এই কোণ থেকে তাওয়াফ শুরু এবং এখানেই শেষ করতে হয়। এই কোণকে রুকনে শারকি বলা হয়। শারকী শব্দের অর্থ হচ্ছে পূর্ব। এই কোণের ঠিক সামনেই রয়েছে যমযম কূপ। হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করে প্রথম যে কোণটি অতিক্রম করতে হয় সেটাকে বলা হয় রুকনে ইরাকি। ইরাকের দিকে অবস্থিত বলে এটাকে রুকনে ইরাকি বলা হয়। তাওয়াফের ধারাবাহিকতায় রুকনে ইরাকির পরই অতিক্রম করতে হয় রুকনে গারবী। এটাকে রুকনে শামীও বলা হয়। কারণ ভৌগোলিকভাবে এটি শাম বা সিরিয়ার দিকে অবস্থিত। কাবাঘরের চতুর্থ কোণ হচ্ছে ইয়েমেনের দিকে অবস্থিত রুকনে ইয়ামানি। আবার এটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত বলে এটিকে দক্ষিণ কোণও বলা হয়। প্রতিবার তাওয়াফ শেষে নবী করিম (স.) রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করতেন।
হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম সম্পর্কে নবীজি (স.) বলেছেন, নিশ্চয়ই হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহীম জান্নাতের দুটি অতি মূল্যবান ইয়াকুত পাথর। পৃথিবীতে প্রেরণের সময় মহান আল্লাহ তাআলা এই পাথর দুটির ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে দিয়েছেন। তা নাহলে এদের আলোতে সমস্ত পৃথিবী এমনভাবে আলোকিত হয়ে থাকত যে দিন-রাত্রির পার্থক্য বোঝা যেত না। অন্য এক হাদিছে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে প্রেরণের সময় হাজরে আসওয়াদ দুধের মতো সাদা ছিল। কিন্তু মানুষের পাপের স্পর্শে সেটা কালো রং ধারণ করেছে।
মাকামে ইব্রাহিম হচ্ছে জান্নাতের অতি মূল্যবান ইয়াকুত পাথর। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এটির উপর দাঁড়িয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেছেন। ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.) পাথর সংগ্রহ করে এনে এগিয়ে দিতেন। আর তিনি এই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কাবাঘরের দেয়াল নির্মাণ করেছেন। এ সময় তার প্রয়োজন অনুযায়ী পাথরটি উঠানামা করত। হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পায়ের ছাপ সংবলিত পাথরটি আজো কাবা চত্বরে সুরক্ষিত আছে।
নবী করিম (স.)-এর অসিয়ত অনুযায়ী, তার শাসনামল থেকে আজ পর্যন্ত বনি শায়রা গোত্রের কাছে কাবাঘরের দরজার চাবি সংরক্ষিত আছে। বংশ পরম্পরায় তারা আজো এর রক্ষক। কারণ, নবীজি স্বয়ং তাদেরকে এই সম্মানে ভূষিত করে গেছেন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কাবাঘর জিয়ারতের তাওফিক দান করুন। নবীজির স্মৃতিবিজড়িত প্রত্যেকটি স্থান দেখার তাওফিক দান করুন। আমিন।