ধর্ম ডেস্ক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৭:২৭ পিএম
প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এই অমোঘ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই। মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময় হচ্ছে কবরের জগৎ বা আলমে বরযখ। ভেবে দেখুন তো আখেরাতের প্রথম মনজিলে বা কবরে কেমন হবে আপনার প্রথম প্রহর? চিন্তা করুন সেদিন কে হবে আপনার সঙ্গী?
“তিনটি বস্তু তোমাদেরকে কবর পর্যন্ত অনুসরণ করবে; তোমাদের পরিবার, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের আমল। প্রথম দুটি (কবর থেকে) ফিরে আসবে এবং শেষটি তোমাদের সঙ্গে রয়ে যাবে।” বুখারি, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৬৭)।
কবরজীবনের প্রথম প্রহর কেমন হবে— এ বিষয়ে সাহাবি বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে আনসার গোত্রের এক ব্যক্তির জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য কবরের কাছে গেলাম। কিন্তু তখনও কবর খনন শেষ হয়নি। তাই রাসুলুল্লাহ (স.) বসে পড়েন। আমরাও তার চারদিকে নীরবে তাকে ঘিরে বসে পড়লাম, যেন আমাদের মাথার ওপর পাখি বসে আছে। তখন তার হাতে ছিল একখানা লাঠি, তা দিয়ে তিনি মাটিতে আঁচড় কাটছিলেন। অতঃপর তিনি মাথা তুলে দুই বা তিনবার বললেন, তোমরা আল্লাহর কাছে কবরের আজাব থেকে আশ্রয় চাও। (আহমদ, মিশকাত হা/১৬৩০; বঙ্গানুবা মিশকাত হা/১৫৪২, মান-সহিহ)
আবু বকর (রা.) -এর মেয়ে আসমা (রা.) বলেন, ‘নবী কারিম (স.) একদিন আমাদের মাঝে খুতবা দিলেন। তাতে কবরের আলাচনা করলেন। কবরের ফেতনার কথা শুনে মুসলমানগণ চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন’। (বুখারি, মেশকাত হা/১৩৭)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখা হয় এবং তার সঙ্গীগণ সেখান হতে ফিরতে থাকে, তখন সে তাদের পায়ের শব্দ শুনতে পায়। তাদের ফিরে যেতে না যেতেই তার নিকট দুজন ফেরেশতা চলে আসেন এবং তাকে উঠিয়ে বসান। তারপর নবী কারিম (স.) -এর প্রতি ইশারা করে জিজ্ঞেস করেন তুমি দুনিয়াতে এ ব্যক্তি সম্পর্কে কী ধারণা করতে? মুমিন ব্যক্তি তখন বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তখন তাকে বলা হয়, এই দেখে নাও জাহান্নামে তোমার স্থান কেমন জঘন্য ছিল। আল্লাহ তোমার সেই স্থানকে জান্নাতের সঙ্গে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তখন সে উভয় স্থান দেখে এবং খুশি হয়। কিন্তু মৃত ব্যক্তি যদি মুনাফিক বা কাফের হয়, তখন তাকে বলা হয়, দুনিয়াতে তুমি এ ব্যক্তি সর্ম্পকে কী ধারণা করতে? তখন সে বলে আমি বলতে পারি না। মানুষ যা বলত, আমিও তাই বলতাম। তখন তাকে বলা হয়, তুমি তোমার বিবেক দ্বারা বুঝার চেষ্টা করনি কেন? আল্লাহর কিতাব পড়ে বোঝার চেষ্টা করনি কেন? অতঃপর তাকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে এমনভাবে পেটাতে শুরু করে, সে হাউমাউ করে বিকট চিৎকার করতে থাকে। আর এত জোরে চিৎকার করে যে, মানুষ ও জিন ছাড়া সবকিছুই তার চিৎকার শুনতে পায় (বুখারি, মুসলিম, বাংলা মিশকাত হা/১১৯)
কিন্তু ‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী, তাদের ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং যারা জালেম, আল্লাহ তাদের বিভ্রান্তিতে রাখবেন; আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।’ (সুরা ইবরাহিম: ২৭)
জারির (রহ.)-এর বর্ণনায় রাসুল (স.) আরো ইরশাদ করেন, মৃত ব্যক্তি তাদের জুতার শব্দ শুনতে পায় যখন তারা ফিরে যেতে থাকে, আর তখন তাকে বলা হয়, হে অমুক, তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কী এবং তোমার নবী কে?
বর্ণনাকারী হান্নাদ (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, অতঃপর তার কাছে দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে প্রশ্ন করে, তোমার রব কে? তখন সে বলে, আমার রব আল্লাহ। তারা উভয়ে তাকে প্রশ্ন করে, তোমার দ্বিন কী? সে বলে, আমার দ্বিন ইসলাম। তারা প্রশ্ন করে, এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে? সে বলে, তিনি আল্লাহর রাসুল (স.)। তারপর তারা আবার জিজ্ঞেস করে, তুমি কী করে জানতে পারলে? সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি এবং তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি।
জারির (রহ.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, এটাই হলো আল্লাহর এ বাণীর অর্থ— ‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী, তাদের ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন’
এরপর বর্ণনাকারী জারির ও হান্নাদ উভয়ে একইভাবে বর্ণনা করেন—
অতঃপর আকাশ থেকে ঘোষণা আসে, আমার বান্দা যথাযথ বলেছে। সুতরাং তার জন্য জান্নাতের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও। এছাড়া তার জন্য জান্নাতের দিকে একটা দরজা খুলে দাও। তিনি (স.) বলেন, সুতরাং তার দিকে জান্নাতের স্নিগ্ধকর হাওয়া ও তার সুগন্ধি বইতে থাকে। তিনি আরো বলেন, ওই দরজা তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করা হয়।
অতঃপর নবী (স.) কাফিরদের মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেন, তার রুহকে তার শরীরে ফিরিয়ে আনা হয় এবং দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে প্রশ্ন করে, তোমার রব কে? সে উত্তর দেয়, হায়! আমি কিছুই জানি না। তারপর তারা প্রশ্ন করেন, তোমার দ্বিন কী? সে বলে, হায়! আমি কিছুই জানি না। অতঃপর তারা প্রশ্ন করে, এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে? সে বলে, হায়! আমি তো জানি না। তখন আকাশ থেকে ঘোষণা আসে, সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরিয়ে দাও, আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দরজা খুলে দাও।
তিনি (স.) বলেন, অতঃপর তার দিকে জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস আসতে থাকে। এ ছাড়া তার জন্য তার কবরকে সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়, ফলে তার এক দিকের পাঁজর অপর দিকের পাঁজরের মধ্যে ঢুকে যায়। জারির বর্ণিত হাদিসে আছে, অতঃপর তার জন্য এক অন্ধ ও বধির ফেরেশতাকে নিযুক্ত করা হয়, যার সঙ্গে একটি লোহার হাতুড়ি থাকবে, যদি এ দ্বারা পাহাড়কে আঘাত করা হয় তাহলে তা ধুলায় পরিণত হয়ে যাবে।
নবী (স.) বলেন, তারপর সে তাকে হাতুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করতে থাকে, এতে সে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে, যা মানুষ ও জিন ছাড়া পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সব সৃষ্টি জীবই শুনতে পায়। আঘাতের ফলে সে মাটিতে মিশে যায়। তিনি বলেন, অতঃপর (শাস্তি অব্যাহত রাখার জন্য) পুনরায় তাতে রুহ ফেরত দেওয়া হয়। (আবু দাউদ: ৪৭৫৩)
ওসমান (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি যখন কোনো কবরের পাশে দাঁড়াতেন, তখন এমনভাবে কাঁদতেন যে, তার দাড়ি ভিজে যেত। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি জাহান্নামের এবং জান্নাতের কথা স্মরণ করেন, অথচ কাঁদেন না, কিন্তু কবর দেখলেই কাঁদেন, ব্যাপার কী? তিনি বললেন, রাসুল (স.) বলেছেন—
পরকালের বিপদজনক স্থানসমূহের মধ্যে কবর হচ্ছে প্রথম। যদি কেউ সেখানে মুক্তি পেয়ে যায়, তাহলে তার পরের সব স্থান সহজ হয়ে যাবে। আর যদি কবরে মুক্তি লাভ করতে না পারে, তাহলে পরের স্থানগুলো আরও কঠিন ও জটিল হয়ে যাবে। অতঃপর তিনি বললেন, নবী কারিম (স.) এটাও বলেছেন যে, আমি এমন কোনো জঘন্য ও ভয়াবহ স্থান দেখিনি, যা কবরের চেয়ে জঘন্য ও ভয়াবহ। (তিরমিজি বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২৫, মান-সহিহ)
আল্লাহ তাআলা বলেন ‘যারা সৎকাজ করে, তারা নিজেদের জন্যই রচনা করে শান্তির আবাস।’ (সুরা রুম: ৪৪)
আপনি কি ভালো কাজ করেছেন? যা আপনার কাছে আসবে সুদর্শন চেহারা হয়ে, সুন্দর পোশাক ও সুঘ্রাণসহ এক ব্যক্তির রূপ ধরে। অতঃপর আপনার উদ্দেশে বলবে ‘সুসংবাদ গ্রহণ করো, যা তোমাকে সন্তুষ্ট করবে, এটা তোমার সেদিন যার ওয়াদা করা হতো। আমি তোমার সৎকর্ম।’ (মুসনাদে আহমদ)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার তাওফিক দিন এবং কবরের ভয়াবহ আজাব থেকে রক্ষা করুন।